দুঃখে ভরা সুখের চরের মানুষদের
- আপডেট সময় : ১০:৫১:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ৬২৭ বার পড়া হয়েছে
গত আটদিন ধরে পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন চিলমারীর নয়ারহাট ইউনিয়নের সুখের চর গোয়াইলবাড়ি গ্রামের রাজ্জাক প্রামাণিক ও রূপবানু দম্পতি। ঘরের ভেতর চৌকি ছুঁই ছুঁই পানি। ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষা চরের বাড়িটিতে মৃদু স্রোত বয়ে যাচ্ছে কখনও কখনও। সাতদিনের মধ্যে ৫ কেজি গমের আটা কেনা হয়েছিল তাদের। তাই দিয়ে চলছে কোনমতে। কিন্তু আর চলছেনা। তাই শুক্রবার সকালে পোষা তিনটি মোরগ মুরগি নিয়ে পাশের জাফরগঞ্জ হাটে গেছেন রাজ্জাক প্রামাণিক। এদিকে বাড়িতে কাজ করছেন রূপবানু। শুক্রবার বিকেলে গেলে এসব কথা হয় তার সঙ্গে।
রূপবানু জানান, দুই বছর আগে নদী বাড়ি ভাঙলে এ চরে বাড়ি করেন। তারপর থেকে চারবার বন্যার পানি ভাসিয়েছে তাদের। এমন অনেক দিন খেয়ে না খেয়ে পার করছেন তারা। স্রোতে ভেসে যাওয়ার ভয় নিয়ে থাকেন রাতে। বলেন, ‘আস্টদিন (৮দিন) কি কষ্ট গেল। ঘরে পানির উপর শুবার পারিনা। ডর করে। ভাইসা যাই নাহি। সাপ, ব্যাঙ আসে। খাওয়া নাই। আজ তিনডা কুরকা (মোরগ) হাডে নিয়্যা গেল। বেইচ্চা চাল আনলে খাওন হবো।’ কথার মাঝে কপালের চিন্তার ছাপ বলে দেয় কতোটা দুঃসহ জীবন পারছেন তারা।
পাশের উত্তর খাওরিয়া নাইয়ার চরের বাসিন্দা আব্দুর রশিদ। তিনি বাড়িতে নেই। নৌকা দেখে কোমর পানি ভেঙে বাইরে আসেন আব্দুর রশিদের স্ত্রী শুকুরজান বেগম। পাশে পানিতে খেলছে দুই শিশু ছেলে। তাদের বাড়িতেও আট দিন ধরে পানি।
দুঃখ দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ছইলদের খাওন দিতে পারছিনা গো বাবা। পোলার বাপে হাটে গেছে মোরগ নিয়া। বেইচ্চা কিছু নিয়ে আইবো। তার কথায় বোঝা গেল বাড়ির কর্তার খাবার কিনে আনার অপেক্ষায় পানিবন্দী পরিবার।
নৌকা দেখে অদূরের বাড়ি থেকে ছেলেকে পিঠেতে নিয়ে আসেন পতিহারা ফিরোজা। তার ধারণা ছিল ত্রাণের নৌকা ভিরছে সেখানে। আশা নিয়ে আসছিলেন। তিনি বলেন, পোলারে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাহি। এতো পানি গেলো একদিন কেউ কিচ্চু নিয়া আসলোনা।
ব্রহ্মপুত্রের ওই চরটিতে অন্তত অর্ধশত বাড়িতে বন্যার পানি। সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্যার ঠান্ডা ঘোলা পানিতে চলাচল করছেন এ ঘর ও ঘর। কোন বাড়িতে রান্না হয় চৌকির ওপর বসানো চুলায়। কোন বাড়িতে হয়না। কেউ কেউ নৌকায় থাকেন। বৃষ্টি এলে ঘরে থাকেন।
কষ্টে আছে এখানকার পানিবন্দী প্রতিবন্ধী মনোয়ারা। জানা গেল তার স্বামী মাইদুল ও প্রতিবন্ধী। অনেকের মতো তাদেরও পানিবন্দী দুর্বিষহ জীবন কাটছে কয়দিন ধরে।
খোজ নিয়ে জানা গেল চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের দ্বীপচরের নয়ারহাট ইউনিয়নের কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দী এক সপ্তাহ ধরে। সবার অবস্থা একই রকম। দূর্ভোগ শেষ নেই।
এ বছরে চতুর্থবারের মতো বন্যা হচ্ছে কুড়িগ্রামে। এবার বন্যা যেন “নিশ্চুপ বন্যা”। পানিবন্দী কয়েক হাজার পরিবার। সবাই চর দ্বীপ চরের বাসিন্দা। নদনদীর ভাঙনে দু’চার বার নিঃস্ব হওয়া মানুষরা অর্থাভাবে নিচু এলাকাগুলোতে বাড়ি করেছেন অনেকটা বাধ্য হয়ে। বার বার বন্যায় তারা যেন নুয়ে পড়ছেন গোড়া ছেঁড়া ডগার মতন। ঝিমিয়ে পড়ছেন দিনে দিনে।
এ বন্যায় জেলার সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের কিছু অংশ, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ, হাতিয়া ও সাহেবের আলগা এবং চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট, চিলমারী, রমনা ও অষ্টমীরচর ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী জীবন যাপন করছেন। বন্যার শোরগোল না থাকায় স্থানীয় প্রশাসনও অনেক ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছেন। শুক্রবার থেকে পানিবন্দি মানুষদের মাঝে ১০ কেজি করে চাল ত্রাণ বিতরণ করেছেন। তবে বলাই যায় বানভাসিদের সংখ্যা ও সংকটের তুলনায় তার খুবই অপ্রতুল।
চরে দেখা গেল নয়ারহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান নৌকা করে চাল বিতরণ করছেন। তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নে ৫ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ পাওয়া দিয়েছে। শুক্রবার সেগুলো পানিবন্দী পরিবাগুলোর মাঝে বিতরণ করছেন।
জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা শুক্রবার জানায়, জেলায় ৫ হাজার ২৮০ পরিবারের ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে চলমান বন্যায়। দুর্গত পরিবারগুলোর মাঝে ১৮২ মেট্রিকটন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও নগদ ৯ লাখ টাকা বিতরণ চলমান রয়েছে।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, শুক্রবার দিনভর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি স্থিতিশীল থেকে নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার এবং চিলমারী পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যান্য নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, দুর্গত পরিবারগুলোর মাঝে প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে।