পাইলট সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের বিমান সংস্থাগুলো। প্রশিক্ষণ একাডেমির অভাবে, বছরে চাহিদার চেয়ে পাইলট তৈরি হচ্ছে তিন গুণ কম। এতে উচ্চ বেতনে বিদেশি বৈমানিক আনা এবং দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। সংকট কাটাতে প্রশিক্ষণ একাডেমির সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ এভিয়েশন সংশ্লিষ্টদের।
দেশের এভিয়েশন খাতের উন্নয়নে বিমানবন্দরগুলোর অবকাঠামোর নানা উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। বেড়েছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজের বহর। বেসরকারি কোম্পানিগুলোও এগিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। বাড়ছে নতুন রুট।
এতে চাহিদা বাড়ছে পাইলটের। উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ৪-৫ বছর ধরে, প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ জন পাইলটের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। বিপরীতে, ফ্লাইং একাডেমি থেকে পাইলট বের হচ্ছেন ১০ থেকে ১২ জন।
অনেকদিন ধরেই দেশের পাইলট ট্রেনিং একাডেমিগুলো নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশে একসময় তিনটি বেসরকারি পাইলট ট্রেনিং একাডেমি থাকলেও বর্তমানে টিকে আছে দুটি। এর মধ্যে একটির অবস্থা মুমূর্ষু।
দেশের সবচেয়ে বড় পাইলট ট্রেনিং একাডেমি আরিরাং এভিয়েশন ২০২০ সালে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন পাইলট তৈরির প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি ধুঁকছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। আর গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমি বছরে সর্বোচ্চ ১০ জন পাইলট তৈরি করছে। এর বাইরেও বিমান বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে অনেক কর্মকর্তাই বেসামরিক উড়োজাহাজের পাইলট হিসেবে যোগ দেন।
সাধারণত একটি উড়োজাহাজ ওড়াতে প্রয়োজন হয় দুজন পাইলট। একজন ক্যাপ্টেন, যিনি মুলত উড়োজাহাজটি নিয়ন্ত্রণ করেন, আর তাঁকে সহযোগিতা করেন একজন ফার্স্ট অফিসার। আইকাও-এর নির্দেশনা অনুযায়ী একজন পাইলটের মাসে নির্ধারিত কর্মঘণ্টা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ৬০ ঘণ্টা এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ৭৫ ঘণ্টা। কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট হওয়ায় একটি উড়োজাহাজ পরিচালনার জন্য অন্তত ৬ জন পাইলট প্রয়োজন হয়।
আবার রাতারাতি পাইলট প্রশিক্ষণেরও সুযোগ নেই। সাধারণত ট্রেনিং একাডেমিতে থিউরি ও প্র্যাকটিক্যাল প্রশিক্ষণ নিতে হয় একজন নবীন পাইলটকে। পাইলট হিসেবে লাইসেন্স পেতে দিতে হয় পরীক্ষা। সাধারণত ৫০ ঘণ্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা থাকলে একজন নবীন পাইলট প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স বা পিপিএল লাভ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছোট বা সিঙ্গেল ইঞ্জিনের উড়োজাহাজ ওড়ানোর অনুমতি পান।
বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ ওড়ানোর জন্য কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স বা সিপিএল পেতে হলে একজন নবীন পাইলটের অন্তত ১৫০ ঘণ্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু এই লাইসেন্স পাওয়ার সাথে সাথে তিনি ওড়ার অনুমতি পান না। একেকটি উড়োজাহাজের পরিচালনা পদ্ধতি একেক রকম। সুতরাং তিনি যে মডেলের উড়োজাহাজটি ওড়াবেন সেটির জন্য সিম্যুলেটর প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এটি সাধারণত তিনি যে এয়ারলাইন্সে যোগ দেবেন, সেই এয়ারলাইন্সের তত্ত্বাবধানে হয়। প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হলে তিনি ফার্স্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান।
পাইলট প্রশিক্ষণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় সবার পক্ষে এই প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব হয় না। পিপিএল লাইসেন্স পাওয়ার আগ পর্যন্ত একজন প্রশিক্ষণার্থীর পেছনে খরচ হয় অন্তত ৪০ লাখ টাকা। এর পর পিপিএল ও সিপিএল লাইসেন্স পাওয়ার খরচ তো আছেই। এসব কারণে দেশি পাইলটের জোগানের গতি ধীর হয়ে পড়ছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি শফিউল আজিম বলেন, “আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। মাত্র একটি একাডেমি টিকে আছে। তারা সীমিতসংখ্যক পাইলট বের করছে। আমাদের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, সে অনুপাতে পাইলট তৈরি হচ্ছে না”।
ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের যে চাহিদা, সে অনুযায়ী যে এখানে পাইলট প্রডিউস হবে, সেই পাইপলাইন নাই। আপটু দ্য মার্ক যদি পাইলট না হয়, তাহলে এয়ারলাইন্সগুলো তাদের নিতে পারবে না। ফরেন পাইলটের আধিক্য বাড়ছে কারণ, লোকাল পাইলট পাওয়া যাচ্ছে না। অপারেশন স্মুথ রাখতে হলে পাইলট লাগবে। এখন যেখান থেকেই হোক না কেন, সেটা লাগবে”।
দেশে বেসরকারিভাবে ৩টি ফ্লাইং প্রশিক্ষণ একাডেমি রয়েছে। তবে তার দুটো, প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজের অভাবে বন্ধ রয়েছে একবছরের বেশি সময় ধরে। যেটি চালু আছে, সেটিও বছরে ১০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে না।
“এখন যে উড়োজাহাজগুলো আসছে এগুলো অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। ফলে একজন পাইলটের সে প্রশিক্ষণ না থাকলে তিনি পিছিয়ে পড়বেন। অন্যদিকে, প্রশিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। প্রশিক্ষকরা যখন সুযোগ পাচ্ছেন এয়ারলাইন্সে চলে যাচ্ছেন, ফলে সংকট থেকেই যাচ্ছে”- বলেন এভিয়েশন বিশ্লেষক এটি এম নজরুল ইসলাম।
ফ্লাইং প্রশিক্ষণ শেষে ৪০ ঘণ্টা ওড়ার পরই, বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে পাইলটের লাইসেন্সের আবেদন করা যায়। তবে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালনার জন্য ওড়ার অভিজ্ঞতা থাকতে হয় ১৫০ ঘণ্টা।