চাকরি ছাড়ার উৎসবে মেতেছেন চীনা তরুণেরা এবং চাকরি ছাড়ার পরপরই বন্ধুদের নিয়ে পার্টিও করছেন তাঁরা। এমনই এক তরুণের নাম লিয়াং। চাকরি করতেন ঝেজিয়াং প্রদেশের একটি ব্যাংকে। সম্প্রতি তিনি চাকরি ছেড়ে বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ উৎসব করেছেন। বন্ধুরাও তাঁকে চাকির ছাড়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, যেনতেন পার্টি নয়, বিয়ের পার্টির মতো বাদ্য বাজিয়ে, বেলুন উড়িয়ে বর্ণিল আয়োজনে চাকরি ছাড়ার পার্টি করছেন চীনা তরুণেরা। চীনের অর্থনৈতিক মন্দা ও উচ্চ বেকারত্বের হারের মধ্যে এভাবে তরুণদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হতে পারে। তবে ২৭ বছর বয়সী লিয়াং বলেন, ‘চাকির ছেড়ে এখন আমি একটি ক্যাফে পরিচালনা করছি এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী জীবনযাপন করছি। আগের জীবনটা ছিল একঘেয়ে ও বিরক্তিকর। সেখানে নিজের সৃজনশীলতা বিকাশের কোনও সুযোগ ছিল না।’
চলতি বছরে চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিপুল সংখ্যক তরুণের চাকরি ছাড়ার পোস্ট দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ তরুণের বয়স ২০ বছরের বেশি এবং বেশির ভাগ তরুণ বলছেন, চাকরির কম বেতনে কুলিয়ে উঠতে না পেরে তাঁরা চাকরি ছাড়ছেন।
চীনের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম মাইমাই এক জরিপে জানিয়েছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরের ১ হাজার ৫৫৪ জনের মধ্যে ২৮ শতাংশই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আর যারা এখনও চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক তাঁদের সংখ্যা দ্বিগুণ।
সিএনএন বলেছে, চাকরি ছাড়ার একই ধরনের প্রবণতা দুই বছর আগে আমেরিকায় দেখা গিয়েছিল। তখন প্রায় ৫ কোটি মানুষকে চাকরি ছাড়তে দেখা গেছে। চীনে প্রবণতাটি সবেমাত্র শুরু হতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরণের প্রবণতা চীনের অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। জন্মহারের নিম্নগতি, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ও কর্মশক্তি কমে যাওয়াজনিত সমস্যা নিয়ে চীনা অর্থনীতি ইতিমধ্যেই পর্যুদস্ত। এরমধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যোগ দিয়েছে তরুণদের চাকরি ছাড়ার হিড়িক।
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কেলগ স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের অর্থনীতির অধ্যাপক ন্যান্সি কিয়ান বলেন, ‘চীনের তরুণেরা অনেক বেশি হতাশার মধ্যে রয়েছে। কঠোর পরিশ্রম করেও আশানুরূপ জীবনযাপন করতে না পরার ফলে তাদের মধ্যে এই হতাশা, ক্লান্তি ও বিরক্তি ভর করেছে।’
অধ্যাপক ন্যান্সি কিয়ান আরও বলেন, ‘এই তরুণদের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সময়ে চীনের অর্থনীতি গতিশীল ছিল। তাদের মা বাবা তাদের আশাব্যাঞ্জক ভবিষ্যৎ দেখেছিল। কিন্তু এখন অর্থনীতি মন্থর হওয়ায় তারা মা বাবার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। ফলে হতাশা গ্রাস করেছে তাদেরকে।’
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের জ্ঞান ও দক্ষতার মিল না থাকায় অনেক তরুণ চাকরির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না। এটিও চাকরি ছাড়ার একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ফোশানের বাসিন্দা ভেরন মাই সঙ্গীতে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। কিন্তু তিনি সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে কোথাও চাকরি পাননি। বাধ্য হয়ে একটি রেস্টুরেন্টের সার্ভার পদে চাকির নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে তিনি মানিয়ে নিতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত হীনমন্যতায় ভুগছেন। তিনি বলেন, আমি কীভাবে নিজেকে একজন সঙ্গীত ছাত্র বলতে পারি!
তবে চাকি ছাড়ার এই প্রবণতার একটি ইতিবাচক দিকও দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক কিয়ান বলেন, ‘চাকরি ছেড়ে স্বাধীন পেশায় মনযোগী হচ্ছেন তরুণেরা। এতে তারা পরিবারকে বেশি সময় দিতে পারবেন। ফলে প্রজনন হার বাড়তে পারে। দিন শেষে এটি অর্থনীতির জন্যই সুফল বয়ে আনবে।’
অধ্যাপক কিয়ান আরও বলেন, ‘এই প্রবণতা কতদিন স্থায়ী হবে তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তরুণ বয়সে অনেকেই এ রকম যখন তখন চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন। দুই বছর পর হয়তো হতাশ হয়ে আবার চাকরিজীবনে ফিরে আসবেন।’