ঢাকা ০২:২০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

দুবাই-রিয়াদের সম্পদের গর্জন আর কতদিন?

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৬:৩৯:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩
  • / ৩৫৫ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

তেলনির্ভরতা কমিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কয়েক দশক আগে থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে মধ্যপ্রাচ্যর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও সৌদি আরব। বিনিয়োগ আকর্ষণে গড়ে তোলা হয়েছে নজরকাড়া আকাশচুম্বী সব স্থাপত্য। এর মধ্যে রয়েছে বিলাসবহুল প্রাসাদ, ভিলা, অ্যাপার্টমেন্টসহ পাঁচতারকা হোটেল। গুরুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজানো হয়েছে আবাসন খাত। দুবাইয়ে সমুদ্রের তীরে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পাম আইল্যান্ড। ‘দ্য রিগ’ নামের নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে সৌদি আরব।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পর্যটন খাতকে বিশেষ করে ঢেলে সাজাতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যর এ দেশগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে চায় তারা। এ লক্ষ্যে দেশগুলোর আবাসন খাতে গত দশকে বিনিয়োগ এসেছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। একেকটি রাজকীয় প্রাসাদ, ভিলা বিক্রি হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলারে। সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ের এই উড়ন্ত দামের শেষ কোথায়? বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন যে, সম্পদের এই বৃদ্ধির হার আর কতদিন চলতে পারে? এসব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে।

দুবাই
দুবাই, বিশ্বের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শিল্পের জন্য নজর কেড়েছে সবার। বিভিন্ন ধরনের বিলাসবহুল বাণিজ্যিক ভবনের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল আবাসিক ভবন, পর্যটন কেন্দ্র। যে কারণে বিশ্বের ধনকুবেরদের গন্তব্যস্থল এখন দুবাই। এমিরেটস হিলস, বিলাসবহুল আবাসিক ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে মর্যাদার বিলাসবহুল প্রাসাদ বলা যায়। আর এ কারণেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘বেভারলি হিলস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ওই প্রাসাদকে। বিশ্বের ধনকুবেরসহ বন্ড ভিলেনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত আবাসস্থল এখন দুবাই। আর এমিরেটস হিলস-বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ এবং বিলিয়নিয়ারদের কাছে জনপ্রিয়। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। দুবাইয়ের সমৃদ্ধ এলাকায় অবস্থিত ওই প্রসাদের ইন্টেরিয়র চোখ ধাঁধানো। প্রাসাদের অভ্যন্তর সাজানো হয়েছে প্রায় ৭ লাখ সোনার পাতার শিট দিয়ে। রয়েছে ২৪ ক্যারেট সোনার জ্যাকুজি, ১৬টি গাড়ি রাখা যায় এমন গ্যারেজ এবং ডাইনিং রুমে রয়েছে কোরাল-রিফ অ্যাকোয়ারিয়াম। তবে এর দাম সাধারণের কাছে আকাশচুম্বী। অবশ্য বিলিয়নিয়ারদের কাছে খুব বেশি নয়। জুনে এর দাম চাওয়া হয়েছিল ৭৫০ মিলিয়ন দিরহাম বা ২০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

প্রাসাদটির ওই দামই সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বাণিজ্যিক কেন্দ্র দুবাইয়ের সম্পদের বাজারের রেড-হটের বড় উদাহরণ। এই বাড়তি দামের আঁচ পড়তে শুরু করেছে সৌদি আরবেও। সৌদির রাজধানী রিয়াদেও সম্পদের দাম হুহু করে বাড়ছে। গত বছর উভয় শহরের আবাসনের দাম দুই-অঙ্কের গুণিতকে বেড়েছে। অথচ এই সময়ে বিশ্বের অনেক ধনী দেশের আবাসন খাতে মন্দা ছিল। ফলে দু্বাইয়ে আবাসন খাতে বিনোয়গকারীরা বেশ রোমাঞ্চিত ছিল। তবে বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন যে, সম্পদের এই বৃদ্ধির হার আর কতদিন চলতে পারে?

দুবাইয়ের জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ আসে আবাসন বিনেয়োগকারীদের কাছ থেকে। এর বড় উদাহরণ পাওয়া যায় গত দুই বছরের সম্পদ কেনা-বেচার পরিমাণের দিকে তাকালে। গত বছর রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৭০০টি আবাসন সম্পদ বিক্রি হয়। এটি আগের বছরের চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি। আর ওই সম্পদ লেনদেনের মূল্য বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। ২০২২ সালে ২১৯টি আবাসন প্রকল্প ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়। শুধু ২০২৩ সালের প্রথমার্ধেই সম্পদ বিক্রির লক্ষ্যে এ ধরনের ১৭৬টি চুক্তি হয়েছে। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, দুবাইয়ে বিলাসবহুল বাড়ি বিক্রি দিন দিন বাড়ছে।

দুবাইয়ে আবাসন খাতের সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্তরা ব্যয়বহুল ভিলা বিক্রয়ের রেকর্ড করছে। গত বছর তারা ৭৬ মিলিয়ন থেকে ৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে একেকটি ভিলা বিক্রি করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে একটি পেন্টহাউসে ১১২ মিলিয়ন এবং এর ঠিক তিন মাস পর আরেকটি ১১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে রেকর্ড গড়েছেন।

দেশটির আরেকটি পর্যটন আকর্ষণ হচ্ছে, কৃত্রিম দ্বীপ ‘পাম জুমেইরাহ’। সমুদ্রের বুকে কৃত্রিম এ দ্বীপে শুধু বালিভর্তি খালি প্লটের জন্য ক্রেতারা সম্প্রতি ৩৪ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করেছে। কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এশিয়া এবং রাশিয়ার ধনকুবেরদের কাছে দুবাইয়ের এ শহরের চাহিদা অব্যাহত থাকবে। তারা আরও জাঁকজমকপূর্ণ বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হবেন।

কৃত্রিম দ্বীপ ‘পাম জুমেইরাহ’–এর আরেকটি বড় অংশ পাম জেবেল আলী। গত মে মাসে এ অংশ উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা জানায় সেখানকার প্রশাসন। ২০০৯ সালে আবাসন খাতে ধসের পর থেকে এ দ্বীপে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ রয়েছে। ডেভেলপাররা শহরের উত্তরের আরেকটি কৃত্রিম দ্বীপকে ঘিরে পুনরায় প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে।
সৌদি আরবের দৃষ্টিনন্দন একটি ভবন।

রিয়াদে সম্পদের উল্লম্ফনের কারণ অবশ্য ভিন্ন। দেশটির দেওয়া ভিশন-২০৩০–কে কেন্দ্র করে রিয়াদে সম্পদের মূল্য বাড়তে শুরু করে। তেল নির্ভরতার থেকে সরে এসে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে দেশটির সরকার। ফলে দেশটির নাগরিকেরা চাকরি খুঁজতে রিয়াদে যাচ্ছেন। সরকারি চুক্তি থেকে বাদ পড়া এড়াতে বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে বছরের শেষ নাগাদ তাদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর রিয়াদে স্থানান্তরিত করতে বলা হয়েছে।

চাহিদা বৃদ্ধি মানে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। আর এ বিষয়টি মাথায় রেখে দেশটির সরকার পরিচালিত ডেভেলপাররা কয়েক হাজার নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন। দেশটির এস্টেট প্রতিনিধি নাইট ফ্রাঙ্ক অনুমান করেছেন, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধের শেষে ভিলাগুলোর দাম ১২ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ হারে। তবে দেশটির দ্বিতীয় শহর এবং বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দায় এ হার তুলনামূলক কম ছিল। সেখানকার পরিসংখ্যান বলছে এ হার ছিল ২ শতাংশ এবং ৭ শতাংশ।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালে দেশটির অর্ধেকেরও কম নাগরিক বাড়ির মালিক ছিলেন। বেশির ভাগ যুবক তাদের বাবা–মার সঙ্গে থাকত। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারগুলো থাকত ভাড়া বাড়িতে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বন্ধকী-আমানতের শর্ত শিথিল করে এবং বিভিন্ন ভর্তুকি চালু করে। ফলে ২০২২ সালের আদমশুমারিতে এসে দেখা যায় দেশটির ৬১ শতাংশ মানুষ বাড়ির মালিক হয়েছেন। সরকার ভিশন-২০৩০ সালের আওতায় দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষকে নিজস্ব বাড়ির মালিকানার লক্ষ্য স্থির করেছে। আর সৌদি সরকার সে লক্ষ্য পূরণের পথে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সম্পদের আস্ফালন আর কতদিন?
এখন প্রশ্ন হলো—এই ভিলা, বাড়ি, বা সম্পদের মূল্যর যে আস্ফালন, তা কতদিন টিকবে? যদিও মনে করা হয় তেলের উচ্চমূল্যের কারণে উপসাগরীয় অঞ্চলে সম্পদের এ আকাশচুম্বী দাম। তবে আবাসন খাতে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, আগামী বছর থেকেই দুই শহরের সম্পদের দাম কমতে শুরু করবে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, সৌদি বাজার ইতিমধ্যেই মন্থর হয়ে গেছে। আর এখানেই ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ বছরের প্রথমার্ধে দেশটিতে ৭০ হাজার বাড়ি বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। গত বছরের একই সময়ে ১ লাখ ৩ হাজার বাড়ি বিক্রি হয়েছিল। পাশাপাশি নতুন বন্ধকী সম্পদের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ কমেছে।

যদিও বলা হচ্ছে সম্ভবত ক্রমবর্ধমান সুদহারের কারণে এ অবস্থা তৈরি হচ্ছে। কারণ, সৌদি রিয়ালের সঙ্গে ডলারের তারতম্য বেড়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভকে (ফেড) অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্য এবং মজুরি বৃদ্ধির ওপর। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে সৌদি নাগরিকদের গড় মাসিক আয় ছিল ৯ হাজার ৮৯৩ রিয়াল বা ২ হাজার ৬৩৭ মার্কিন ডলার। গত বছরের একই সময়ের সাথে তুলনা করলে, যা প্রায় অপরিবর্তিত বলা যায়। অবশ্য ২০১৯ সালের তুলনায় এটি ৪ শতাংশ কম।

দুবাইতে আবাসন বাজার মূল অর্থনীতি থেকে দূরে সরে গেছে। ফলে বাণিজ্যিক সম্পত্তির বাজার গত সাত বছর ধরে মন্দায় রয়েছে। আমিরাতের অনেক শপিং মলে দোকান খালি পড়ে আছে। গত এক বছরে আবাসিক ভাড়া বেড়েছে। যদিও ২০১৬ সালের ভাড়া বৃদ্ধির তুলনায় এ হার অনেক কম এখনো। তবুও মধ্যবিত্ত পেশাজীবীরা অস্বস্তিতে রয়েছেন। কারণ, তাদের বেতন বাড়ছে না।

বিলাসবহুল বাড়ি বিক্রয় দুবাইয়ের অর্থনীতিকে শুধু চাঙাই রাখছে না, এটি দেশটির কোষাগারের জন্য একটি ভরসাও বটে। এই খাত থেকে ৪ শতাংশ লেনদেন কর সংগ্রহ করে দেশটি। কিন্তু মুশকিলটা হলো এ খাতের সম্ভাব্য ক্রেতা সীমিত এবং বেশির ভাগ ক্রেতা পুরো সময় শহরে থাকেন না। ফলে এ বিলাসবহুল খাত যেভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখার কথা, সেভাবে রাখছে না।

গত জানুয়ারি মাসে কর্তৃপক্ষ দেশটির ব্যয়বহুল প্রকল্প ‘পার্ল’ ধ্বংস করে দেয়। ওই প্রকল্পে ১৫০০টি অ্যাপার্টমেন্ট এবং সাতটি পাঁচ তারকা হোটেল ছিল। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তারপরও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। তবে স্থানীয়দের ধারণা—ভূমিকম্পে ওই প্রকল্পটি ধ্বংস হয়। বাস্তবতা হলো, এটি ছিল বিগত সময়ের বিলাসী নানা উদ্যোগের নেতিবাচক প্রভাব।

ফলে এখন স্বাভাবিকভাবেই ওই অঞ্চলের অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা দুশ্চিন্তায় আছেন। আবাসন খাতের মতো একটি খাত যখন অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে হাজির হয়, এবং যে খাতের সাথে শুধু অতি ধনীরাই যুক্ত থাকে, যারা আবার সেখানে নিয়মিত অবস্থান করায় তেমন আগ্রহী নয়, তখন এটি গলার কাঁটা হয়ে ওঠার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। মুশকিল হলো— এ ধরনের বিনিয়োগ ও এর ফলে সৃষ্ট অর্থনীতির ধারার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পরবর্তী সময়ে, যার বাজে অভিজ্ঞতা আমেরিকার রয়েছে।

সূত্র: ইকোনোমিস্ট, বিবিসি ও আল-জাজিরা

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

দুবাই-রিয়াদের সম্পদের গর্জন আর কতদিন?

আপডেট সময় : ০৬:৩৯:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩

তেলনির্ভরতা কমিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে কয়েক দশক আগে থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে মধ্যপ্রাচ্যর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও সৌদি আরব। বিনিয়োগ আকর্ষণে গড়ে তোলা হয়েছে নজরকাড়া আকাশচুম্বী সব স্থাপত্য। এর মধ্যে রয়েছে বিলাসবহুল প্রাসাদ, ভিলা, অ্যাপার্টমেন্টসহ পাঁচতারকা হোটেল। গুরুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজানো হয়েছে আবাসন খাত। দুবাইয়ে সমুদ্রের তীরে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পাম আইল্যান্ড। ‘দ্য রিগ’ নামের নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে সৌদি আরব।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পর্যটন খাতকে বিশেষ করে ঢেলে সাজাতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যর এ দেশগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে চায় তারা। এ লক্ষ্যে দেশগুলোর আবাসন খাতে গত দশকে বিনিয়োগ এসেছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। একেকটি রাজকীয় প্রাসাদ, ভিলা বিক্রি হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলারে। সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ের এই উড়ন্ত দামের শেষ কোথায়? বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন যে, সম্পদের এই বৃদ্ধির হার আর কতদিন চলতে পারে? এসব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে।

দুবাই
দুবাই, বিশ্বের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শিল্পের জন্য নজর কেড়েছে সবার। বিভিন্ন ধরনের বিলাসবহুল বাণিজ্যিক ভবনের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল আবাসিক ভবন, পর্যটন কেন্দ্র। যে কারণে বিশ্বের ধনকুবেরদের গন্তব্যস্থল এখন দুবাই। এমিরেটস হিলস, বিলাসবহুল আবাসিক ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে মর্যাদার বিলাসবহুল প্রাসাদ বলা যায়। আর এ কারণেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘বেভারলি হিলস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ওই প্রাসাদকে। বিশ্বের ধনকুবেরসহ বন্ড ভিলেনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত আবাসস্থল এখন দুবাই। আর এমিরেটস হিলস-বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ এবং বিলিয়নিয়ারদের কাছে জনপ্রিয়। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। দুবাইয়ের সমৃদ্ধ এলাকায় অবস্থিত ওই প্রসাদের ইন্টেরিয়র চোখ ধাঁধানো। প্রাসাদের অভ্যন্তর সাজানো হয়েছে প্রায় ৭ লাখ সোনার পাতার শিট দিয়ে। রয়েছে ২৪ ক্যারেট সোনার জ্যাকুজি, ১৬টি গাড়ি রাখা যায় এমন গ্যারেজ এবং ডাইনিং রুমে রয়েছে কোরাল-রিফ অ্যাকোয়ারিয়াম। তবে এর দাম সাধারণের কাছে আকাশচুম্বী। অবশ্য বিলিয়নিয়ারদের কাছে খুব বেশি নয়। জুনে এর দাম চাওয়া হয়েছিল ৭৫০ মিলিয়ন দিরহাম বা ২০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

প্রাসাদটির ওই দামই সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বাণিজ্যিক কেন্দ্র দুবাইয়ের সম্পদের বাজারের রেড-হটের বড় উদাহরণ। এই বাড়তি দামের আঁচ পড়তে শুরু করেছে সৌদি আরবেও। সৌদির রাজধানী রিয়াদেও সম্পদের দাম হুহু করে বাড়ছে। গত বছর উভয় শহরের আবাসনের দাম দুই-অঙ্কের গুণিতকে বেড়েছে। অথচ এই সময়ে বিশ্বের অনেক ধনী দেশের আবাসন খাতে মন্দা ছিল। ফলে দু্বাইয়ে আবাসন খাতে বিনোয়গকারীরা বেশ রোমাঞ্চিত ছিল। তবে বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন যে, সম্পদের এই বৃদ্ধির হার আর কতদিন চলতে পারে?

দুবাইয়ের জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ আসে আবাসন বিনেয়োগকারীদের কাছ থেকে। এর বড় উদাহরণ পাওয়া যায় গত দুই বছরের সম্পদ কেনা-বেচার পরিমাণের দিকে তাকালে। গত বছর রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৭০০টি আবাসন সম্পদ বিক্রি হয়। এটি আগের বছরের চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি। আর ওই সম্পদ লেনদেনের মূল্য বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। ২০২২ সালে ২১৯টি আবাসন প্রকল্প ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়। শুধু ২০২৩ সালের প্রথমার্ধেই সম্পদ বিক্রির লক্ষ্যে এ ধরনের ১৭৬টি চুক্তি হয়েছে। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, দুবাইয়ে বিলাসবহুল বাড়ি বিক্রি দিন দিন বাড়ছে।

দুবাইয়ে আবাসন খাতের সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্তরা ব্যয়বহুল ভিলা বিক্রয়ের রেকর্ড করছে। গত বছর তারা ৭৬ মিলিয়ন থেকে ৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে একেকটি ভিলা বিক্রি করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে একটি পেন্টহাউসে ১১২ মিলিয়ন এবং এর ঠিক তিন মাস পর আরেকটি ১১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে রেকর্ড গড়েছেন।

দেশটির আরেকটি পর্যটন আকর্ষণ হচ্ছে, কৃত্রিম দ্বীপ ‘পাম জুমেইরাহ’। সমুদ্রের বুকে কৃত্রিম এ দ্বীপে শুধু বালিভর্তি খালি প্লটের জন্য ক্রেতারা সম্প্রতি ৩৪ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করেছে। কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এশিয়া এবং রাশিয়ার ধনকুবেরদের কাছে দুবাইয়ের এ শহরের চাহিদা অব্যাহত থাকবে। তারা আরও জাঁকজমকপূর্ণ বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হবেন।

কৃত্রিম দ্বীপ ‘পাম জুমেইরাহ’–এর আরেকটি বড় অংশ পাম জেবেল আলী। গত মে মাসে এ অংশ উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা জানায় সেখানকার প্রশাসন। ২০০৯ সালে আবাসন খাতে ধসের পর থেকে এ দ্বীপে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ রয়েছে। ডেভেলপাররা শহরের উত্তরের আরেকটি কৃত্রিম দ্বীপকে ঘিরে পুনরায় প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে।
সৌদি আরবের দৃষ্টিনন্দন একটি ভবন।

রিয়াদে সম্পদের উল্লম্ফনের কারণ অবশ্য ভিন্ন। দেশটির দেওয়া ভিশন-২০৩০–কে কেন্দ্র করে রিয়াদে সম্পদের মূল্য বাড়তে শুরু করে। তেল নির্ভরতার থেকে সরে এসে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে দেশটির সরকার। ফলে দেশটির নাগরিকেরা চাকরি খুঁজতে রিয়াদে যাচ্ছেন। সরকারি চুক্তি থেকে বাদ পড়া এড়াতে বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে বছরের শেষ নাগাদ তাদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর রিয়াদে স্থানান্তরিত করতে বলা হয়েছে।

চাহিদা বৃদ্ধি মানে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। আর এ বিষয়টি মাথায় রেখে দেশটির সরকার পরিচালিত ডেভেলপাররা কয়েক হাজার নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন। দেশটির এস্টেট প্রতিনিধি নাইট ফ্রাঙ্ক অনুমান করেছেন, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধের শেষে ভিলাগুলোর দাম ১২ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ হারে। তবে দেশটির দ্বিতীয় শহর এবং বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দায় এ হার তুলনামূলক কম ছিল। সেখানকার পরিসংখ্যান বলছে এ হার ছিল ২ শতাংশ এবং ৭ শতাংশ।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালে দেশটির অর্ধেকেরও কম নাগরিক বাড়ির মালিক ছিলেন। বেশির ভাগ যুবক তাদের বাবা–মার সঙ্গে থাকত। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারগুলো থাকত ভাড়া বাড়িতে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বন্ধকী-আমানতের শর্ত শিথিল করে এবং বিভিন্ন ভর্তুকি চালু করে। ফলে ২০২২ সালের আদমশুমারিতে এসে দেখা যায় দেশটির ৬১ শতাংশ মানুষ বাড়ির মালিক হয়েছেন। সরকার ভিশন-২০৩০ সালের আওতায় দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষকে নিজস্ব বাড়ির মালিকানার লক্ষ্য স্থির করেছে। আর সৌদি সরকার সে লক্ষ্য পূরণের পথে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সম্পদের আস্ফালন আর কতদিন?
এখন প্রশ্ন হলো—এই ভিলা, বাড়ি, বা সম্পদের মূল্যর যে আস্ফালন, তা কতদিন টিকবে? যদিও মনে করা হয় তেলের উচ্চমূল্যের কারণে উপসাগরীয় অঞ্চলে সম্পদের এ আকাশচুম্বী দাম। তবে আবাসন খাতে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, আগামী বছর থেকেই দুই শহরের সম্পদের দাম কমতে শুরু করবে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, সৌদি বাজার ইতিমধ্যেই মন্থর হয়ে গেছে। আর এখানেই ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ বছরের প্রথমার্ধে দেশটিতে ৭০ হাজার বাড়ি বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। গত বছরের একই সময়ে ১ লাখ ৩ হাজার বাড়ি বিক্রি হয়েছিল। পাশাপাশি নতুন বন্ধকী সম্পদের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ কমেছে।

যদিও বলা হচ্ছে সম্ভবত ক্রমবর্ধমান সুদহারের কারণে এ অবস্থা তৈরি হচ্ছে। কারণ, সৌদি রিয়ালের সঙ্গে ডলারের তারতম্য বেড়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভকে (ফেড) অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্য এবং মজুরি বৃদ্ধির ওপর। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে সৌদি নাগরিকদের গড় মাসিক আয় ছিল ৯ হাজার ৮৯৩ রিয়াল বা ২ হাজার ৬৩৭ মার্কিন ডলার। গত বছরের একই সময়ের সাথে তুলনা করলে, যা প্রায় অপরিবর্তিত বলা যায়। অবশ্য ২০১৯ সালের তুলনায় এটি ৪ শতাংশ কম।

দুবাইতে আবাসন বাজার মূল অর্থনীতি থেকে দূরে সরে গেছে। ফলে বাণিজ্যিক সম্পত্তির বাজার গত সাত বছর ধরে মন্দায় রয়েছে। আমিরাতের অনেক শপিং মলে দোকান খালি পড়ে আছে। গত এক বছরে আবাসিক ভাড়া বেড়েছে। যদিও ২০১৬ সালের ভাড়া বৃদ্ধির তুলনায় এ হার অনেক কম এখনো। তবুও মধ্যবিত্ত পেশাজীবীরা অস্বস্তিতে রয়েছেন। কারণ, তাদের বেতন বাড়ছে না।

বিলাসবহুল বাড়ি বিক্রয় দুবাইয়ের অর্থনীতিকে শুধু চাঙাই রাখছে না, এটি দেশটির কোষাগারের জন্য একটি ভরসাও বটে। এই খাত থেকে ৪ শতাংশ লেনদেন কর সংগ্রহ করে দেশটি। কিন্তু মুশকিলটা হলো এ খাতের সম্ভাব্য ক্রেতা সীমিত এবং বেশির ভাগ ক্রেতা পুরো সময় শহরে থাকেন না। ফলে এ বিলাসবহুল খাত যেভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখার কথা, সেভাবে রাখছে না।

গত জানুয়ারি মাসে কর্তৃপক্ষ দেশটির ব্যয়বহুল প্রকল্প ‘পার্ল’ ধ্বংস করে দেয়। ওই প্রকল্পে ১৫০০টি অ্যাপার্টমেন্ট এবং সাতটি পাঁচ তারকা হোটেল ছিল। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তারপরও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। তবে স্থানীয়দের ধারণা—ভূমিকম্পে ওই প্রকল্পটি ধ্বংস হয়। বাস্তবতা হলো, এটি ছিল বিগত সময়ের বিলাসী নানা উদ্যোগের নেতিবাচক প্রভাব।

ফলে এখন স্বাভাবিকভাবেই ওই অঞ্চলের অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা দুশ্চিন্তায় আছেন। আবাসন খাতের মতো একটি খাত যখন অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে হাজির হয়, এবং যে খাতের সাথে শুধু অতি ধনীরাই যুক্ত থাকে, যারা আবার সেখানে নিয়মিত অবস্থান করায় তেমন আগ্রহী নয়, তখন এটি গলার কাঁটা হয়ে ওঠার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। মুশকিল হলো— এ ধরনের বিনিয়োগ ও এর ফলে সৃষ্ট অর্থনীতির ধারার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পরবর্তী সময়ে, যার বাজে অভিজ্ঞতা আমেরিকার রয়েছে।

সূত্র: ইকোনোমিস্ট, বিবিসি ও আল-জাজিরা