বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘উন্মুক্ত কারাগার’ গাজা
- আপডেট সময় : ০৪:১৬:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩
- / ৪৪২ বার পড়া হয়েছে
ইসরায়েলে কয়েক দশকের মধ্যে গত ৭ অক্টোবর সবচেয়ে বড় রকেট হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী স্বশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এরপর গাজা উপত্যকা পুরোপুরি ঘিরে রেখে হামলা চালানোর নির্দেশ দেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ, খাবার, পানি, জ্বালানি— কোনো কিছুই থাকবে না। সব বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ গ্যালান্ত এমন ঘোষণা দিতে পারার কারণ, ২০০৭ সাল থেকেই সমুদ্র, ভূমি ও আকাশ— সব দিক থেকেই গাজার ফিলিস্তিনিদের এক প্রকার অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল।
গাজার পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, উওর ও পূর্বে ইসরায়েল এবং দক্ষিণে মিসর। এখানে ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির বাস। ১৯৬৭ সালে এক যুদ্ধের মাধ্যমে গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখলে নেয় ইসরায়েল। তবে ২০০৫ সালে গাজা উপত্যকা থেকে সৈন্য এবং প্রায় সাত হাজার বসতি স্থাপনকারীদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
এখনো গাজাকে ‘অধিকৃত’ অঞ্চল হিসেবেই আখ্যা দেয় জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এই ‘অধিকৃত’ ও অবরোধের কারণেই গাজাকে ‘উন্মুক্ত কারাগার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী। এই তালিকায় আছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও।
গাজায় অবরোধের শুরুটা কবে
১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে জয়ের পর মিসর থেকে গাজা দখল করে নেয় ইসরায়েল। এরপরই এ অঞ্চলের সামরিক দখলদারিত্ব শুরু করে। ১৯৬৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ২১টি বসতি স্থাপন করা হয়। এর পর জোর করে সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। সরে যাওয়ার জন্য আর্থিক লোভও দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের সরিয়ে নেওয়া যায়নি। ১৯৬৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই জবরদস্তির বিরোধিতা করেছেন ফিলিস্তিনিরা। এ কারণে বহু সহিংস ও অহিংস প্রতিবাদ হয়েছে।
২০০৫ সালে গাজা থেকে বসতি সরিয়ে নেয় ইসরায়েল। এরপর ২০০৭ সাল পর্যন্ত গাজায় ফিলিস্তিনিদের চলাচল ও পণ্য আসা–যাওয়ার ব্যাপারে মাঝেমাঝেই বাধা দিত। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি-পিএনএ বা ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ। ওই চুক্তিতে গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়।
উভয় পক্ষের মধ্যে এই বোঝাপড়া হয় যে, ফিলিস্তিনিরা স্বশাসনের আংশিক অধিকার পাবে এবং ইসরায়েল প্রথমে পশ্চিম তীরের জেরিকো এবং তারপর গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এর পরিবর্তে, ইসরায়েলি রাষ্ট্রের বৈধতা স্বীকার করে নেবে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও।
কিন্তু অবরোধ থেকেই যায়। এই অবরোধের মধ্যেই ২০০৬ সালে নির্বাচনে গাজায় হামাস নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। নির্বাচনের পর হামাস ও আরেকটি রাজনৈতিক দল ফাতাহ গোষ্ঠির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েক শ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। এসবের মধ্যেই ২০০৭ সালে হামাস ক্ষমতায় থাকাবস্থাতেই গাজা পুরোপুরি অবরোধ করে ইসরায়েল। অরবোধ দেয় মিসরও। গাজা থেকে বের হওয়া ও ঢোকার সব পথই প্রায় বন্ধই করে দেওয়া হয়। এমনকি পণ্য পরিবহন এবং বিদেশি সহায়তায়ও বাধা দেয় ইসরায়েল। বলা হয়, নিরাপত্তার স্বার্থেই এমন করা হয়েছে।
অবরোধের দেয়াল ও পারাপারে বাধা
তিন পাশেই দেয়াল, একদিকে ভূমধ্যসাগর। এক প্রকার কারাগারেই বাস করতে হচ্ছে গাজাবাসীকে। সীমান্তের এই বেড়া দেওয়া শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। ওই বছর ৬০ কিলোমিটার এলাকায় এমন বেড়া দেয় ইসরায়েল। এর পর সময় যত গড়িয়েছে, এই বেড়া আকারে–প্রকারে আরও বড় হয়েছে। ৭ মিটার উঁচু দেয়াল তোলার পাশাপাশি সীমান্তে বসানো হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এমনকি মাটির নিচের টানেলগুলোও এক প্রকার বন্ধই রাখা হয়। রাখা হয় সয়ংক্রিয় ও ভারী অস্ত্র।
উত্তর ও পূর্বে ইসরায়েলের বেড়া। এদিকে দক্ষিণেও দেয়াল দেয় মিসর। এর পর গাজাবাসীকে আরও অবরুদ্ধ করে রাখতে আমেরিকার সহায়তায় নেয় ইসরায়েল। ১৪ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বসানো হয় স্টিলের প্রতিবন্ধক। এটি মাটির নিচেও কার্যকর।
গাজাবাসীর শুধু একটি দিকই খোলা ছিল, সেটি হচ্ছে পশ্চিম। সেই পশ্চিমের সমুদ্র এলাকাতেও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইসরায়েলের। গাজাবাসীকে ওই পথে যেতে দেওয়া হয় না। সীমান্তের তিনটি পথ ব্যবহার করতে পারত গাজাবাসী। এ তিনটি হলো ইসরায়েল সীমান্তের কারিম আবু সালেম ও ইরিজ এবং মিসর সীমান্তের রাফাহ। তবে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করা যেত না। হামাসের সর্বশেষ হামলার পর এই তিনটি পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ঘনবসতি ও দারিদ্রতা
গাজার আয়তন প্রায় ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। আর এখানে বাস করেন ২০ লাখের বেশি মানুষ। বিশ্বের ঘনবতসিপূর্ণ এলাকার মধ্যে গাজা একটি। এই এলাকাই কিনা অরবোধ করে রেখেছে ইসরায়েল। গত বছর জাতিসংঘের অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ওসিএইচএ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অবরোধের কারণে গাজার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে সেখানে বেড়ে যায় বেকার সমস্যা। খাদ্য সংকট, অনিরাপত্তা ও ত্রাণ নির্ভরতার সঙ্গে বাস করতে থাকেন গাজাবাসী।
ওসিএইচএর প্রতিবেদন বলছে, গাজার ৬১ ভাগ মানুষকেই নির্ভর করতে হয় ত্রাণের ওপর। ৩১ ভাগ পরিবার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারে না, বেকার ৪৬ শতাংশের বেশি। দিনে ১১ ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎ থাকে না। এসব অবরোধকে মানবাবিকার লঙ্ঘন বলেই উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
এই অবরোধের কারণে ফিলিস্তিনিদের বসবাসের আরেক অঞ্চল পশ্চিম তীরে যাওয়া যায় না। অথচ পারিবারিক যোগসূত্র, ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও চিকিৎসার কারণে ফিলিস্তিনিদের প্রায়ই ওই এলাকায় যেতেই হয়। ইসরায়েল সেই পথও বন্ধ করে রেখেছে।
‘উন্মুক্ত কারাগার’
অধিকৃত এলাকায় জাতিসংঘে বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করা ফ্রান্সেস্কো আলবানেস বলেন, ‘এত কিছুর পর আর কি–ই বা বন্ধ করে দেওয়ার বাকি থাকে। একটি কারাগারেও এর চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা যায়। গাজা হচ্ছে একটি উন্মুক্ত কারাগার।’
এ ব্যাপারে ২০১২ সালেই কথা বলেছিলেন মার্কিন দার্শনিক নোয়াম চমস্কি। তাঁর কথায়, বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারে টিকে থাকার চেষ্টা কেমন হবে, তা উপলব্ধি করতে গাজায় এক দিনের বেশি সময় লাগে না। এর আগেই বোঝা যায়।