ঢাকা ০৫:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

হামাসের হামলায় ইসরায়েল পড়েছে যেসব ঝামেলায়

অর্ণব সান্যাল
  • আপডেট সময় : ০৫:৩৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৩
  • / ৫২৪ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

এবারের গাজা সংকটে প্রথম হামলা হামাস করেছে। এরপরই নিজেদের সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইসরায়েল। তবে অক্টোবরের ৭ তারিখে হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল রয়েছে পুরো শাঁখের করাতে। এই অপ্রত্যাশিত হামলার কারণে ইসরায়েলের বেশ কিছু হিসাব-নিকাশ উল্টেপাল্টে গেছে। এমনকি বর্তমান সংকট কোন প্রক্রিয়ায় সমাধানের পথে যেতে পারে, তা নিয়েও বিভ্রান্তিতে পড়েছে নেতানিয়াহুর দেশ।

ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থী দল হামাস ইসরায়েলের শহরগুলোতে হঠাৎ করেই হামলা চালিয়ে বসেছে। এর পাল্টা হিসেবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তেল আবিব। এখন পর্যন্ত চলা এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং লাশের সংখ্যা শুধু বাড়ছেই। হামাস প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, মুসলিমদের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান আল-আকসা রক্ষার জন্যই এ হামলা। ওদিকে ইসরায়েল জানিয়ে দিয়েছে হামাসের হামলার কড়া জবাব দেওয়া হবে।

তবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও এবং এরই মধ্যে ফিলিস্তিনে স্থল ও আকাশপথে ইসরায়েল টানা হামলা চালালেও, দিনশেষে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চরম সিদ্ধান্তহীনতায় আছে দেশটি। এটি সত্যি যে, গাজায় এবারের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে ইসরায়েলের ঘরের উঠোনে নিয়ে ফেলেছে হামাস। এটি এমনই এক পরিস্থিতি যে, ইসরায়েলকে জবাব দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এখন এর মধ্য দিয়েই ইসরায়েল একটি বিশাল ফাঁদে আটকে গেছে। কারণ, বর্তমান সংকট থেকে বের হওয়ার কোনো সোজা-সরল রাস্তা পাচ্ছে না নেতানিয়াহুর দেশ।

প্রথম সমস্যা: হামাসকে দমন করতে ইসরায়েল এরই মধ্যে স্থলপথে অভিযান শুরু করেছে এবং গাজা উপত্যকায় ঢুকছে। এই পদক্ষেপের মূল কারণ একটাই, গাজা উপত্যকার ওপর হামাসের যে নিয়ন্ত্রণ, সেটিকে হালকা করে দেওয়া। এ ছাড়া গাজার অধিবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং হামাসের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতেও এই স্থল অভিযান কাজে দেবে বলে ইসরায়েলের ধারণা। এই পদক্ষেপ সফল হলে, হামাসকে পুরোপুরি কোণঠাসা করার অবস্থায় নিয়ে যেতে পারবে ইসরায়েল। কিন্তু এই কাজটি সুসম্পন্ন করাই সমস্যা। কারণ গাজা খুবই জনবহুল একটি স্থান। এক কথায় খুবই ঘিঞ্জি জায়গা গাজা। ফলে স্থলপথে অভিযান চালাতে গিয়ে অভিযানকারীদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। যেমন—২০১৪ সালের সংকটের সময় এই স্থলপথের অভিযান চালাতে গিয়ে ৬৬ ইসরায়েলি সেনার মৃত্যু হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আশঙ্কা আছে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার। ২০১৪ সালের সংঘাতে ২ হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষের মৃত্যু সেই আশঙ্কাকেই আরও শক্ত ভিত্তি দেয়। তেমনটা এবারও হলে মানবিক বিপর্যয় আরও সঙিন হয়ে উঠতে পারে এবং তাতে বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি আরও খারাপ বৈ ভালো হবে না।

দ্বিতীয় সমস্যা: হামাসের হামলার আগে মধ্যপ্রাচ্যের বড় ও শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল ইসরায়েল। যেমন—সৌদি আরবের সঙ্গে বেশ জোরদার আলোচনা চলছিল দেশটির। এর বাইরে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর সঙ্গেও এক ধরনের আলোচনার আবহ সৃষ্টির চেষ্টায় ছিল ইসরায়েল। কিন্তু হামাসের হামলায় এসব প্রচেষ্টা এখন ধূলিসাৎ হওয়ার জোগাড়। সৌদি আরব এর মধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করেছে। বর্তমান সংকটের জন্য ইসরায়েলের দিকে অভিযোগের আঙুলও তুলেছে। এসব কারণে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ফের ব্রাত্য হয়ে পড়ার অবস্থায় চলে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে করে আঞ্চলিক রাজনীতিতে দেশটি আবার কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে জোরেশোরেই। হামাসকে আরও কঠোরভাবে দমনের দিকে ইসরায়েল গেলে স্বাভাবিকভাবেই মানবিক বিপর্যয় বাড়বে গাজা উপত্যকায়। আর তাতে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইসরায়েলের কূটনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা আর কমতে থাকবে।

তৃতীয় সমস্যা: এবার সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামলা করেছে হামাস। ইসরায়েলের জন্য এটি অবশ্য অভাবিত এবং চমক জাগানিয়া একটি ঘটনা। বেসামরিক ইহুদি জনগণকে হত্যা ও নির্যাতনের পাশাপাশি অনেক ইসরায়েলি নাগরিককে জিম্মি করেও নিয়ে গেছে হামাসের সদস্যরা। জিম্মি হওয়া ইসরায়েলি নাগরিকদের সংখ্যা সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কোনো পক্ষই কিছু জানায়নি। তবে কিছু বিদেশি গণমাধ্যম বলছে, সংখ্যাটি ১৫০ হতে পারে। জিম্মি হওয়া এই নাগরিকদের ফিরিয়ে আনা নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছে ইসরায়েল। কারণ, জিম্মি ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘসূত্রী। এর আগে হামাসের কাছে জিম্মি এক সেনাসদস্যকে ফিরিয়ে আনতে নেতানিয়াহুর সরকারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ২০০৬ সালে হামাসের হাতে বন্দী হওয়া ওই একজনের মুক্তির বদলে ২০১১ সালে ১ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল ইসরায়েল। এখন জিম্মি থাকা ইসরায়েলি নাগরিকের সংখ্যা যদি ১৫০ হয়, তবে তাদের ফিরিয়ে আনতে ইসরায়েল সরকারকে কী পরিমাণ ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা সহজেই অনুমেয়। আর দর কষাকষির এই সুবিধাটি নিতে চাইবে হামাসও।

চতুর্থ সমস্যা: হামাসের এবারের হামলাকে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বিজয় হিসেবে ধরে নিয়ে অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আছে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন কমিটির কাছে। হামাসকে ঘৃণা করেন মাহমুদ আব্বাসেরা। সেই নীতি অনুযায়ীই নিজেদের এলাকায় থাকা ফিলিস্তিনি জনগণকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। কিন্তু সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলা হামাসের প্রতি ফিলিস্তিনি জনগণের এক ধরনের আকর্ষণ তো আছেই। বর্তমান সংকটে সেই মোহ আরও গাঢ় হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এমনিতেই গত কয়েক মাসে পশ্চিম তীরের বসতিতে সহিংসতার হার অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, পশ্চিম তীরে তৃতীয় ইন্তিফাদা আন্দোলন শুরু হয়ে যেতে পারে। এখন যদি হামাসের প্রতি ফিলিস্তিনিদের সহানুভূতি আরও বাড়ে এবং তারা সশস্ত্র সংঘাতে অংশ নেওয়া শুরু করে, তবে ইসরায়েলের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। আর এই ভয়েই এখন আছেন ইহুদি অধ্যুষিত দেশটির নীতিনির্ধারকেরা।

পঞ্চম সমস্যা: ধরা যাক, শেষ পর্যন্ত হামাসকে কাবু করতে পারল ইসরায়েল। কিন্তু ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামলা করার এই সুনির্দিষ্ট ধরনটির পুনরাবৃত্তি ঠেকানো কঠিন ও জটিল বিষয়। এ ক্ষেত্রে হামাস ও অন্যান্য শত্রুপক্ষকে ইসরায়েলের এটি বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তার দেশের ভেতরে ঢুকে হামলা করলেই বড় মূল্য চোকাতে হবে। এভাবে মনে ভয় ধরানোর কাজটি করতে কঠোর ও সহিংস হওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু কঠোর হতে গেলেই হতাহতের সংখ্যা বাড়বে, মানবিক বিপর্যয় প্রচণ্ড হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে নৈতিকভাবে সঠিক থাকা বা সেই অবস্থান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মতি আদায় করা দুরূহ হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এগোলে কখনোই হামাসকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পারবে না ইসরায়েল। আবার সেটি না হলে সীমানা অতিক্রম করে দেশের ভেতরে ঢুকে হামলা চালানোর ঝুঁকিও রয়ে যাবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা মাথায় নিয়েই ঘুরতে হবে ইসরায়েলি নেতাদের।

এক কথায়, এবারের সংকটে চারপাশ থেকে নানামাত্রিক ঝামেলায় পড়ে গেছে ইসরায়েল। আগে একটা চড় খেলে হাজারটা চড় ফিরিয়ে দিত দেশটি। কিন্তু এবার একটি দেওয়ার আগেও ভাবতে হচ্ছে পরিণতি নিয়ে। কারণ এর ওপরেই নির্ভর করছে ইসরায়েলের জনগণের জানমালের নিশ্চয়তা। আর সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘খলনায়ক’ হয়ে ওঠার আশঙ্কা তো আছেই!

তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ফরেইন অ্যাফেয়ার্স, লোয়ি ইনস্টিটিউট ডট ওআরজি, দ্য ইকনোমিস্ট, ফরেন পলিসি ও সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ

নিউজটি শেয়ার করুন

হামাসের হামলায় ইসরায়েল পড়েছে যেসব ঝামেলায়

আপডেট সময় : ০৫:৩৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৩

এবারের গাজা সংকটে প্রথম হামলা হামাস করেছে। এরপরই নিজেদের সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইসরায়েল। তবে অক্টোবরের ৭ তারিখে হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল রয়েছে পুরো শাঁখের করাতে। এই অপ্রত্যাশিত হামলার কারণে ইসরায়েলের বেশ কিছু হিসাব-নিকাশ উল্টেপাল্টে গেছে। এমনকি বর্তমান সংকট কোন প্রক্রিয়ায় সমাধানের পথে যেতে পারে, তা নিয়েও বিভ্রান্তিতে পড়েছে নেতানিয়াহুর দেশ।

ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থী দল হামাস ইসরায়েলের শহরগুলোতে হঠাৎ করেই হামলা চালিয়ে বসেছে। এর পাল্টা হিসেবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তেল আবিব। এখন পর্যন্ত চলা এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং লাশের সংখ্যা শুধু বাড়ছেই। হামাস প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, মুসলিমদের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান আল-আকসা রক্ষার জন্যই এ হামলা। ওদিকে ইসরায়েল জানিয়ে দিয়েছে হামাসের হামলার কড়া জবাব দেওয়া হবে।

তবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও এবং এরই মধ্যে ফিলিস্তিনে স্থল ও আকাশপথে ইসরায়েল টানা হামলা চালালেও, দিনশেষে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চরম সিদ্ধান্তহীনতায় আছে দেশটি। এটি সত্যি যে, গাজায় এবারের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে ইসরায়েলের ঘরের উঠোনে নিয়ে ফেলেছে হামাস। এটি এমনই এক পরিস্থিতি যে, ইসরায়েলকে জবাব দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এখন এর মধ্য দিয়েই ইসরায়েল একটি বিশাল ফাঁদে আটকে গেছে। কারণ, বর্তমান সংকট থেকে বের হওয়ার কোনো সোজা-সরল রাস্তা পাচ্ছে না নেতানিয়াহুর দেশ।

প্রথম সমস্যা: হামাসকে দমন করতে ইসরায়েল এরই মধ্যে স্থলপথে অভিযান শুরু করেছে এবং গাজা উপত্যকায় ঢুকছে। এই পদক্ষেপের মূল কারণ একটাই, গাজা উপত্যকার ওপর হামাসের যে নিয়ন্ত্রণ, সেটিকে হালকা করে দেওয়া। এ ছাড়া গাজার অধিবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং হামাসের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতেও এই স্থল অভিযান কাজে দেবে বলে ইসরায়েলের ধারণা। এই পদক্ষেপ সফল হলে, হামাসকে পুরোপুরি কোণঠাসা করার অবস্থায় নিয়ে যেতে পারবে ইসরায়েল। কিন্তু এই কাজটি সুসম্পন্ন করাই সমস্যা। কারণ গাজা খুবই জনবহুল একটি স্থান। এক কথায় খুবই ঘিঞ্জি জায়গা গাজা। ফলে স্থলপথে অভিযান চালাতে গিয়ে অভিযানকারীদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। যেমন—২০১৪ সালের সংকটের সময় এই স্থলপথের অভিযান চালাতে গিয়ে ৬৬ ইসরায়েলি সেনার মৃত্যু হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আশঙ্কা আছে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার। ২০১৪ সালের সংঘাতে ২ হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষের মৃত্যু সেই আশঙ্কাকেই আরও শক্ত ভিত্তি দেয়। তেমনটা এবারও হলে মানবিক বিপর্যয় আরও সঙিন হয়ে উঠতে পারে এবং তাতে বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি আরও খারাপ বৈ ভালো হবে না।

দ্বিতীয় সমস্যা: হামাসের হামলার আগে মধ্যপ্রাচ্যের বড় ও শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল ইসরায়েল। যেমন—সৌদি আরবের সঙ্গে বেশ জোরদার আলোচনা চলছিল দেশটির। এর বাইরে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর সঙ্গেও এক ধরনের আলোচনার আবহ সৃষ্টির চেষ্টায় ছিল ইসরায়েল। কিন্তু হামাসের হামলায় এসব প্রচেষ্টা এখন ধূলিসাৎ হওয়ার জোগাড়। সৌদি আরব এর মধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করেছে। বর্তমান সংকটের জন্য ইসরায়েলের দিকে অভিযোগের আঙুলও তুলেছে। এসব কারণে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ফের ব্রাত্য হয়ে পড়ার অবস্থায় চলে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে করে আঞ্চলিক রাজনীতিতে দেশটি আবার কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে জোরেশোরেই। হামাসকে আরও কঠোরভাবে দমনের দিকে ইসরায়েল গেলে স্বাভাবিকভাবেই মানবিক বিপর্যয় বাড়বে গাজা উপত্যকায়। আর তাতে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইসরায়েলের কূটনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা আর কমতে থাকবে।

তৃতীয় সমস্যা: এবার সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামলা করেছে হামাস। ইসরায়েলের জন্য এটি অবশ্য অভাবিত এবং চমক জাগানিয়া একটি ঘটনা। বেসামরিক ইহুদি জনগণকে হত্যা ও নির্যাতনের পাশাপাশি অনেক ইসরায়েলি নাগরিককে জিম্মি করেও নিয়ে গেছে হামাসের সদস্যরা। জিম্মি হওয়া ইসরায়েলি নাগরিকদের সংখ্যা সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কোনো পক্ষই কিছু জানায়নি। তবে কিছু বিদেশি গণমাধ্যম বলছে, সংখ্যাটি ১৫০ হতে পারে। জিম্মি হওয়া এই নাগরিকদের ফিরিয়ে আনা নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছে ইসরায়েল। কারণ, জিম্মি ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘসূত্রী। এর আগে হামাসের কাছে জিম্মি এক সেনাসদস্যকে ফিরিয়ে আনতে নেতানিয়াহুর সরকারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ২০০৬ সালে হামাসের হাতে বন্দী হওয়া ওই একজনের মুক্তির বদলে ২০১১ সালে ১ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল ইসরায়েল। এখন জিম্মি থাকা ইসরায়েলি নাগরিকের সংখ্যা যদি ১৫০ হয়, তবে তাদের ফিরিয়ে আনতে ইসরায়েল সরকারকে কী পরিমাণ ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা সহজেই অনুমেয়। আর দর কষাকষির এই সুবিধাটি নিতে চাইবে হামাসও।

চতুর্থ সমস্যা: হামাসের এবারের হামলাকে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বিজয় হিসেবে ধরে নিয়ে অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আছে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন কমিটির কাছে। হামাসকে ঘৃণা করেন মাহমুদ আব্বাসেরা। সেই নীতি অনুযায়ীই নিজেদের এলাকায় থাকা ফিলিস্তিনি জনগণকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। কিন্তু সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলা হামাসের প্রতি ফিলিস্তিনি জনগণের এক ধরনের আকর্ষণ তো আছেই। বর্তমান সংকটে সেই মোহ আরও গাঢ় হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এমনিতেই গত কয়েক মাসে পশ্চিম তীরের বসতিতে সহিংসতার হার অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, পশ্চিম তীরে তৃতীয় ইন্তিফাদা আন্দোলন শুরু হয়ে যেতে পারে। এখন যদি হামাসের প্রতি ফিলিস্তিনিদের সহানুভূতি আরও বাড়ে এবং তারা সশস্ত্র সংঘাতে অংশ নেওয়া শুরু করে, তবে ইসরায়েলের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। আর এই ভয়েই এখন আছেন ইহুদি অধ্যুষিত দেশটির নীতিনির্ধারকেরা।

পঞ্চম সমস্যা: ধরা যাক, শেষ পর্যন্ত হামাসকে কাবু করতে পারল ইসরায়েল। কিন্তু ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামলা করার এই সুনির্দিষ্ট ধরনটির পুনরাবৃত্তি ঠেকানো কঠিন ও জটিল বিষয়। এ ক্ষেত্রে হামাস ও অন্যান্য শত্রুপক্ষকে ইসরায়েলের এটি বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তার দেশের ভেতরে ঢুকে হামলা করলেই বড় মূল্য চোকাতে হবে। এভাবে মনে ভয় ধরানোর কাজটি করতে কঠোর ও সহিংস হওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু কঠোর হতে গেলেই হতাহতের সংখ্যা বাড়বে, মানবিক বিপর্যয় প্রচণ্ড হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে নৈতিকভাবে সঠিক থাকা বা সেই অবস্থান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মতি আদায় করা দুরূহ হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এগোলে কখনোই হামাসকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পারবে না ইসরায়েল। আবার সেটি না হলে সীমানা অতিক্রম করে দেশের ভেতরে ঢুকে হামলা চালানোর ঝুঁকিও রয়ে যাবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা মাথায় নিয়েই ঘুরতে হবে ইসরায়েলি নেতাদের।

এক কথায়, এবারের সংকটে চারপাশ থেকে নানামাত্রিক ঝামেলায় পড়ে গেছে ইসরায়েল। আগে একটা চড় খেলে হাজারটা চড় ফিরিয়ে দিত দেশটি। কিন্তু এবার একটি দেওয়ার আগেও ভাবতে হচ্ছে পরিণতি নিয়ে। কারণ এর ওপরেই নির্ভর করছে ইসরায়েলের জনগণের জানমালের নিশ্চয়তা। আর সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘খলনায়ক’ হয়ে ওঠার আশঙ্কা তো আছেই!

তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ফরেইন অ্যাফেয়ার্স, লোয়ি ইনস্টিটিউট ডট ওআরজি, দ্য ইকনোমিস্ট, ফরেন পলিসি ও সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ