কুর্দিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ অনেকটাই ফিকে
- আপডেট সময় : ০৬:১৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৩
- / ৫৫৪ বার পড়া হয়েছে
ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরান। চারটি ভিন্ন দেশ। অজস্র বৈপরীত্য থাকলেও এই চার দেশ একটি জায়গায় এক। আর তা হলো কুর্দি প্রশ্নে। এই চার দেশেই কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর বহু মানুষের বাস। ভৌগোলিকভাবে এবং ভাষাগতভাবে আলাদা হলেও জাতিগত শুধু নয়, স্বাধীনতার দাবিতেও তারা এক। কিন্তু তাদের বহু বছরের এই দাবি আদায়ের সম্ভাবনা ক্রমশই ফিকে হয়ে আসছে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রহীন জাতি কুর্দিদের ওপর হামলা-নির্যাতন প্রশ্নে এই চার দেশ বলা যায় একই আচরণ করছে। সম্প্রতি ইরাকি কুর্দিস্তানের সুলাইমানিয়াহ শহরের বিমানবন্দরে একটি বিমান হামলা হয়। যেখানে প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তানের (পিইউকে) কাউন্টার-টেরোরিজম গ্রুপের তিন সদস্য নিহত ও আহত হয়েছেন অনেকে।
জাতিতে কুর্দি কিন্তু সম্প্রদায়ে বৃহৎ অংশ সুন্নি মুসলমান। বর্তমানে আশ্রয়স্থল হিসেবে চারটি পৃথক রাষ্ট্র-ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরানে পরাধীনভাবে বাস করছে তারা। ইরাক ও সিরিয়া আরবিভাষী; তুরস্ক তুর্কিভাষী এবং ইরান ফার্সিভাষী। নিজ ভূখণ্ডে বসবাসের পরও পৃথক রাষ্ট্রাধীনের নাগরিক, অধিকারবিহীন এক জাতি কুর্দিরা।
তিন দশক ধরে যখন ইরাক বিপর্যস্ত হচ্ছিল, তখন কুর্দিস্তান তুলনায় উন্নত হয়েছিল।এই অঞ্চল সমগ্র দেশের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে ক্রমবর্ধমান ছিল। সেখানে আধুনিক কমপ্লেক্স, হোটেল এবং হাইওয়ে নির্মিত হয়েছিল। ২০১৭ সালে স্বাধীনতা ভোটে অঞ্চলটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে হয়েছিল। তবে ছয় বছরে সেই স্বপ্ন আজ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
ইরাকের রাজধানী বাগদাদ, উন্নত নিরাপত্তা এবং তেল রাজস্বের জন্য এর শাসকেরা কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসনকে ধ্বংস করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, স্বশাসনের পর কুর্দিদের অর্থনীতি, সীমান্ত, ক্রীড়া অঞ্চল এবং রাজনীতি বেশির ভাগই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরে এসেছে। কুর্দি আঞ্চলিক সরকার (কেআরজি) তার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এ বিষয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকেরা বলছেন, কুর্দিস্তান প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ইকোনমিস্টের মতে, কুর্দিদের এই পরিস্থিতির জন্য তারা নিজেরাই কিছুটা দায়ী। তাদের দুই সামন্ত পরিবারের মধ্যে বিরোধ আজ চরমে পৌঁছেছে। পশ্চিমে শাসনকারী বারজান এবং পূর্বে তালাবান-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব সময়ের সাথে তীব্র হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে, তাদের নেতারা তরুণদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। বারজানির কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (কেডিপি) এবং তালাবানির প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তান (পিইউকে)- ক্রমহ্রাসমান সম্পদ নিয়ে বিবদমান। তাদের মন্ত্রীরা প্রায়ই বাগদাদের মন্ত্রিসভার সাথেও লড়াই করছে।
এ দুই দলের মধ্যে পিইউকে প্রকাশ্যে বাগদাদের কাছে সমর্থনের জন্য আবেদন করেছে। দলটির নেতা বাফেল তালাবানি বলেছেন, ‘ইরাক কুর্দিস্তানের চেয়ে ভালো। ’ পশ্চিমাদের আহ্বান সত্ত্বেও দুটি দল তাদের পৃথক বাহিনীকে একত্রিত করতে অস্বীকার করেছে। শুধু তাই নয় পরস্পরের নেতা-কর্মীদের গুপ্তহত্যাও করছে তারা।
কুর্দি পার্লামেন্টের শেষ অধিবেশনটি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়, যা সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে কুর্দিদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। বেড়েছে নিপীড়ন। শুধু তাই নয় গত বছর যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তা ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নে যে কুর্দিস্তান একসময় প্রশংসা পেয়েছে, সেখানেই এখন মুক্তমতের পরিসর সংকোচিত হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালে ইরাকি কুর্দিরা তাদের বহুল প্রতীক্ষিত স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। সে সময় ইরাকের পুরোনো স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে কুর্দিরা জেগে ওঠার পর বাগদাদ যে শক্তি হারিয়েছিল, তা ফিরে পেতে এখন ইরাক কুর্দিদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকেই কাজে লাগাচ্ছে।
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। চলতি বছরের শুরুর দিকে ইরাকের সুপ্রিম কোর্ট প্যারিসে আন্তর্জাতিক আদালতে বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ক এক আদেশকে কাজে লিগিয়ে কুর্দিদের তেল বিক্রিকে বেআইনি ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে দিনে সাড়ে ৪ লাখ ব্যারেল তেল বিক্রি থেকে হওয়া আয় থেকে বঞ্চিত হয় গোষ্ঠীটি। কুর্দি সরকারি কর্মীদের বেতন এখন পুরোপুরি বাগদাদের ওপর নির্ভরশীল। বাগদাদ থেকে কুর্দি আঞ্চলিক সরকারকে সহায়তা না দিলে বেতন–ভাতা আটকে যাওয়ার শঙ্কায় থাকতে হয় তাদের। এর প্রভাব পড়েছে পুরো স্বাধীনতার দাবির ওপরই। কুর্দি নেতারা এখন বাধ্য হয়েই বাগদাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেখানে একসময় তাঁরা বাগদাদকে পরিহার করেছিলেন।
কুর্দি আঞ্চলিক সরকারের (কেআরজি) প্রেসিডেন্ট নেচিরভান বারজানি গত চার বছরে বাগদাদে দশটি সরকারি সফর করেছেন। অথচ তাঁর বাবা এবং সাবেক কেআরজির সাবেক প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি ১৫ বছরে একবার বাগদাদ সফর করেছিলেন। গত জুনে পাস হওয়া নতুন বাজেটে কেআরজির যেকোনো প্রদেশ এখন বাগদাদের কাছ থেকে সরাসরি তহবিল চাইতে পারে। এটি তালাবানদের বারজানি-অধ্যুষিত কেআরজি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে প্রলুব্ধ করতে পারে। ফলে অঞ্চলটির ঐক্য বলতে আর কিছু থাকবে না।
এদিকে বাগদাদের সরকারও কুর্দিদের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কেআরজির ক্রসিং এবং বিমানবন্দরগুলোতে পাহারা বসিয়েছে। ফলে কুর্দি অঞ্চলে কে প্রবেশ করছে বা করছে না, তা এখন বাগদাদের নজরদারিতে রয়েছে। এ বিষয়ে এক ইরাকি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে দ্য ইকোনমিস্ট জানায়, তালেবানরা এখনো গাড়ির বহর এবং ইরান থেকে পাচার করা সিগারেট থেকে আয় করে। কিন্তু এটি আর বেশি দিন থাকবে না। ইরাক থেকে তুরস্কের তেল ক্রয় স্থগিতের ফলে কুর্দিরা এই ধরনের লেনদেন থেকে উপার্জন করতে ব্যবহৃত ট্রানজিট ফিও খরচ করেছে। এ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক আদালত বলেছে, তুরস্ক ইরাকের সম্মতি ছাড়াই কুর্দি আঞ্চলিক সরকারের কাছ থেকে তেল আমদানি করেছে এবং ইরাককে প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে।
দক্ষিণে, ইরাকি সেনাবাহিনী এবং এর সাথে সম্পর্কিত শিয়া মিলিশিয়ারা ২০১৭ সালে গণভোটের পর কুর্দিদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা বিতর্কিত অঞ্চলগুলোতে নিজেদের দখল সুসংহত করছে৷ তারা কুর্দিদের দাবি করা জমিতে আরবদের বসতি স্থাপনের জন্য উত্সাহিত করে জনমিতি সাজাচ্ছে। আজ যদি সেই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে কুর্দিরা সেসব অঞ্চলে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ নাও হতে পারে।
ইকোনমিস্টের মতে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর বিষয়টি সম্ভবত আইনি। গত মে মাসে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট কুর্দিস্তানের নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে এবং ইরাকের সাথে কুর্দি নির্বাচন কমিশন প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি পলাতক ইরাকি আন্দোলনকারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবেও কুর্দিস্তান তার মর্যাদা হারাচ্ছে।
গত বছর কুর্দি নিরাপত্তাকর্মীরা আমেরিকান থিঙ্ক-ট্যাঙ্কে কর্মরত এক ইরাকি গবেষককে আটক করে বাগদাদের কাছে হস্তান্তর করে। এ ছাড়া সাংস্কৃতিকভাবে বাগদাদের অগ্রগতিও প্রভাব ফেলছে। তিন দশক ধরে কুর্দিরা তাদের নিজস্ব ভাষা প্রচার করেছে এবং আরবাইজেশন বা আরবীয়করণের পুরোনো বাথিস্ট প্রকল্পকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এমনকি একটি প্রজন্ম আরবি বলতে ভুলে গেছে। কিন্তু এখন কুর্দিদের মধ্যে তা আবার ফিরে আসছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
একদিকে কুর্দিস্তানে ইরাকি আরবদের প্রভাব বাড়ছে, অন্যদিকে রাজধানী বাগদাদে কুর্দিদের প্রভাব কমছে। ইরানপন্থী শিয়া উপদল দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারকে আধিপত্য বিস্তার করছে। এ কাজে তারা কুর্দি নেতাদের পাশাপাশি এখন সুন্নি সম্প্রদায় ও খ্রিষ্টানদের মতো ইরাকের অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে পাশে রাখছে। অর্থাৎ, কুর্দি নেতারা অনেক ক্ষেত্রে নিজ জাতির বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হচ্ছেন।
এক সময় কুর্দিরা একটি স্বাধীন দেশের জন্য, স্বাধীকারের জন্য পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে ছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলো ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর একটি অ-অনুমোদিত নো-ফ্লাই জোন দিয়ে কুর্দিদের নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেছিল। কিন্তু পশ্চিমাদের আগ্রহও কমে গেছে। ২০০৩ সালে আমেরিকা যখন ইরাক দখল করে, তখন কুর্দিরা তাদের নো-ফ্লাই জোন হারিয়ে ফেলে। যদিও আমেরিকানরা এখনো কুর্দিস্তানে একটি বিমানঘাঁটি রেখেছে। তবে কুর্দিদের অভিযোগ—ইরানের শিয়ারা তাদের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করলে ওই ঘাঁটি থেকে তারা কোনো সমর্থন পায় না।
ইরানের কুর্দিদের অবস্থাও একই। ইরান যেহেতু শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল, তাই সুন্নি কুর্দিরা এখানে উপযুক্ত মর্যাদা পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবতাও তাই। ইরান সর্বদা কুর্দিদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে। তাদের দাবি-দাওয়া কঠোর হাতে দমন করা হয়। ফলে ইরানে কুর্দিরা শোষণ আর বঞ্চনার প্রতীক হয়েই আছে। ইরানের কুর্দি জনগোষ্ঠীর মানুষ স্বায়ত্তশাসনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে পিডিআই নামের এক সশস্ত্রগোষ্ঠী। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে ২০২২ সালে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সানান্দাজ কারাগারে ৪৮ বছর বয়সী হায়দার গোরবানি নামের এক কুর্দি বিদ্রোহী নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে ইরান সরকার।
তবে কুর্দিদের হাতে যে কিছু নেই, তা নয়। তাদের হাতে এখনো কিছু ট্রাম্প কার্ড আছে, যা এখনো খেলা বাকি। তারা চীনাদের শরণাপন্ন হয়েছে। চীন সেখানে একটি বাঁধ, একটি সিমেন্ট কারখানা ও ৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের আবাসন প্রকল্প করার সম্ভাবনা রয়েছে। এর বাইরে কুর্দিরা তারা বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর স্রোত বাইরে উজিয়ে দিয়ে পশ্চিমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে চাইলেই। ইরাক, ইরান বা তুরস্ক থেকে তারা ইউরোপে যাত্রা করলে, পশ্চিমারা তখন চোখ বুঁজে থাকতে পারবে না।
কিন্তু বেশির ভাগ কুর্দিই এখন হতাশাগ্রস্ত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, তুরস্ক, ইরান এবং সিরিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৩ কোটি কুর্দিদের জন্য স্বাধীনতার বাতিঘরটি ক্রমেই ম্লান হতে শুরু করেছে।
ফলে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, এ অঞ্চলের কুর্দিদের ভবিষ্যৎ কী তাহলে? আগামীতে কী ঘটবে তাদের ভাগ্যে? এসব প্রশ্নের আপাতত কোনো উত্তর না মিললেও এতটুকু বলা যায়, কুর্দিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন এখন সুদূর পরাহত। দৈবিক কিছু না ঘটলে কুর্দিদের স্বাধীনতা লাভের আশা একেবারে ক্ষীণ। একমাত্র আলোচনাই পারবে এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান এনে দিতে।