৪টি নির্বাচনের আগে সংলাপের ফলাফল যা হয়েছিল
- আপডেট সময় : ০৫:৪৪:৫১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৩
- / ৪৩০ বার পড়া হয়েছে
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আর বাকী তিন মাসেরও কম। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশ নেবে না বলেই জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। শুধু অংশ নেবে না বলে বিএনপি চুপচাপ বসে আছে, এমনটা নয়। তারা বলেছ, ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। তা না হলে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না দলটি।
আপাত দৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ এই দাবি মেনে নেবে না। অথবা বলা যায় ক্ষমতাসীন দলকে এই দাবি মেনে নেওয়ানোর মতো জোরালো আন্দোলন এখন পর্যন্ত গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। অতীতে এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিদেশিরা সংকট সমাধানে দলগুলোকে (মূলত আওয়ামী লীগ–বিএনপি) সংলাপে বসার কথা বলেছেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ থেকে ঘুরে যাওয়ার গত ১৫ অক্টোবর আমেরিকার পর্যবেক্ষক দল পাঁচটি সুপারিশ করেছে। এরমধ্যে এক নম্বরে আছে সংলাপের কথা। বলা হয়েছে, খোলামনে কথা বলতে হবে।
কিন্তু অতীত বলছে, এ দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সংলাপ সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা। আর চলমান পরিস্থিতিতে প্রধান রাজনৈতিক দুটি পক্ষ সংলাপের আগেই নিজ নিজ শর্ত আরোপ করে বসে আছে। যে শর্ত দুটি আবার পরস্পর বিপরীত মেরুর। ফলে এই অবস্থান থেকে তারা সরে না এলে সংলাপ সফল হওয়া তো দূরস্থান আদৌ সংলাপ হবে কিনা, এটা বলা কঠিন। তবে রাজনীতি স্থায়ী শত্রু–মিত্র যেমন নেই, তেমনি অনড় শর্ত বলেও কিছু হয় না। আর আলাপ–আলোচনা ছাড়া কোনো সমস্যার, বিশেষ করে রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসা সম্ভব না।
১৯৯০ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে। এরপর আরও ছয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। একমাত্র ২০০১ সালের নির্বাচন ছাড়া অন্য সব নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্য দেখা গেছে।
ফলে –ষষ্ঠ–সপ্তম, নবম, দশম ও একাদশ এই চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আলোচনা কিংবা সংলাপ হয়েছে। এর মধ্যে দুবার হয়েছে বিদেশিদের মধ্যস্থতায়। এই চারটি সংলাপের মধ্যে তিনটি সংলাপই ব্যর্থ হয়েছিল। এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে একটি সংলাপ সফল হয়েছিল।
১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে আনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে আনে তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা জোরালো আন্দোলনও গড়ে তোলে। হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি তখন জোরেশোরে পালিত হয়। তখন কমনওয়েলথের তরফ থেকে সমস্যা সমাধানে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে ঢাকায় আসেন স্যার নিনিয়ান স্টেফান। কিন্তু সে আলোচনা সফল হয়নি।
স্টেফান তখন ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন। তিনি সর্বদলীয় একটি সরকার গঠনেরও প্রস্তাব করেন। তিনি তৎকালীন বিএনপি সরকার ও আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের সদস্যদের নিয়ে এই সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। সেই সরকারে একজন টেকনোক্রেট মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের দূত। কিন্তু সেই প্রস্তাব গ্রহন করেনি আওয়ামী লীগ। তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতেই অনঢ় থাকে। ফলে সমাধান ছাড়াই ফিরে যান নিনিয়ান।
পরে বিএনপি সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি একতরফা এবং বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সরকার এক মাসের বেশি টিকতে পারেনি। এটা ছিল ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পরে সংবিধান সংশোধনের করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তিন মাসের মধ্যে আবারও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল এবং বিএনপির মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়ার মধ্যে সংসদ ভবনে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে আলোচনার বিষয় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার। সেখানে তখনকার বিরোধীদল আওয়ামী লীগ একটি প্রস্তাব তুলে ধরে।
প্রথম দিন সংলাপ শেষে আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া বলেন, ১৪ দল ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের দাবিগুলো তাঁর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি তাদের প্রত্যেকটি দাবি সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। তারা ব্যাখ্যা করেছে। তিনি এসব ব্যাখ্যা তাঁর দলের (বিএনপি) তুলে ধরে আলোচনা করবেন। এ সময় মান্নান ভুঁইয়ার পাশে ছিলেন আব্দুল জলিল।
তখনকার সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের তরফ থেকে দুটি দাবিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের না থাকা এবং দুই. প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে বিচারপতি এমএ আজিজের পদত্যাগ। কিন্তু এ দুটি বিষয়ে বিএনপির দিক থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া আসেনি।
একদিকে আওয়ামী লীগ রাস্তায় আন্দোলন করতে থাকে এবং অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখ বিচারপতি কেএম হাসান প্রধান উপদেষ্টার পদ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে নেন।কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী রাজনৈতিক জোট নির্বাচন থেকে সরে যায়।
শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ওই নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ফলে প্রায় দুই বছর সেনা-সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনা করে।
২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ২০১১ সালে এসে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংসদে বাতিল হয়ে যায়। এরপর থেকে ওই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপি আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলন ঘিরে সংহিসতাও হয়। তখনো সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
মধ্যস্ততার জন্য ভোটের আগে দেশে আসেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তারানকো তার সফরের সময় বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেছেন। এর পাশাপাশি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সাথেও বৈঠক করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি বড় দুই দলের সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিবের সাথে একত্রে বৈঠক করেন। কিন্তু উভয়পক্ষ নিজ নিজ দাবিতে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধান ছাড়াই ফিরে যান তিনি।
নির্বাচন ঘিরে সবশেষ সংলাপটি হয় ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ওই সময় রাজপথে আন্দোলন করছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই ফ্রন্টের নেতৃত্বে ছিলেন গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সাত দফা দাবিতে সরকারকে আলোচনায় বা সংলাপে বসার জন্য ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর চিঠি দেওয়া হয়। এর পরদিন ৩০ অক্টোবর সংলাপে বসার সম্মতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনকে চিঠি দেন। পরে ১ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা সংলাপে বসেন।
এই সংলাপের পর শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যেতে অনড় বিএনপি জোট মত পাল্টায় এবং নির্বাচনে অংশ নেয়। সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরও একবার ভূমিধ্বস বিজয় হয়। টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
অবশ্য সংলাপের আগেই বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিল। তবে সংলাপে সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস তাদের ভোটে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ সহজ করে দিয়েছিল।
আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ সফল করেছে। গত ১৫ অক্টোবর দলটি এক বিবৃতিতে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের পরামর্শ দিয়েছে। এর আগে অবশ্য দেশীয় বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান দুই মেরুতে হওয়ায় সংকটের সমাধান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কেবল সংলাপের জন্য সংলাপ আদৌ কোনো কাজে আসবে? সংলাপের আগে পর্দার আড়ালে একটা সমাধান হওয়া দরকার। কারণ সফল সংলাপ না হলে বা বারবার সংলাপ ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে সংলাপে আগ্রহ হারাতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো।