তাঁর রান যখন ৯৫, ম্যাট হেনরিকে উড়িয়ে মেরেছিলেন কোহলি। বাংলাদেশের ম্যাচের মতো আজও ছক্কা মেরে দলকে জেতানোর পাশাপাশি নিজের সেঞ্চুরিও পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শটটা ঠিকমতো হলো না। মিডউইকেট বাউন্ডারির একটু সামনে ফিলিপসের হাতে ধরা পড়লেন কোহলি। ধর্মশালার গ্যালারি তখন কী স্তব্ধ! যেন ভারত হেরে গেছে!
ভারত জিতেছে ঠিকই। নিউজিল্যান্ডের ২৭৪ রানের লক্ষ্য বেশ সহজেই ৪ উইকেট আর ১২ বল হাতে রেখে পেরিয়ে গেছে। এ জয়ের নায়ক কোহলিই। ইনিংসের মাঝপথে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে এক পর্যায়ে ১৯১/৫ হয়ে যাওয়া ভারতের পথ হারানোর শঙ্কা যদি কিছু থেকে থাকেও বা, সেটা তো হতে দেয়নি কোহলির ১০৪ বলে ৮ চার ও ২ ছক্কায় ৯৫ রানের ইনিংসই। শুধু ভারতের জয়ের পাশাপাশি টানা দ্বিতীয় ম্যাচে কোহলির সেঞ্চুরিটাও হলো না, এ-ই যা আজ অপ্রাপ্তি থাকতে পারে ধর্মশালার দর্শকের।
আহা, টানা দ্বিতীয় ম্যাচে দলকে জেতানো শটে সেঞ্চুরি করার কী চেষ্টাটাই না করেছেন বিরাট কোহলি। কিন্তু নিউজিল্যান্ড আর বাংলাদেশের মতো কোহলিকে সে সুযোগ দিল না! এই সেঞ্চুরিটা হলে অবশ্য সেটা বিশেষই হতো। ভারতীয় কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের সমান ৪৯ ওয়ানডে সেঞ্চুরি হতো কোহলির।
সে না হয় আরেকদিন হবে! কে জানে, এই বিশ্বকাপেই হয়তো টেন্ডুলকারকে পেরিয়ে যাবেন কোহলি। যেভাবে খেলছেন, তাতে ইঙ্গিত তো সেরকমই। তবে আজ সেঞ্চুরি না হলেও দলকে জেতানোর কারণেই একটা স্বস্তি সঙ্গী হবে কোহলির। জয় যখন ৮৫ রান দূরে, সূর্যকুমারের রানআউটে ভারতের পঞ্চম উইকেটের পতন হলো তখন এবং তাতে কোহলিরই দায় বেশি। বোল্টের ফুল লেংথের বলটাতে ডিফেন্সিভ শট খেলেই সিঙ্গেল নিতে চেয়েছিলেন সূর্যকুমার। কাভারে যাওয়া বলটাতে সিঙ্গেলের কল কোহলিরই, দুজনই এগিয়েছিলেন রান নিতে। কিন্তু কাভারে স্যান্টনার দারুণ ক্ষিপ্রতায় বল ধরে ফেলেছেন দেখে কোহলি পিছিয়ে গেলেন নিজের নন-স্ট্রাইক প্রান্তের ক্রিজের দিকে। কিন্তু সূর্য তো তখনো দৌড়ে চলেছেন। যতক্ষণে কোহলির পিছু হটা টের পেয়েছেন, দেরি হয়ে গেছে। স্যান্টনার বলটা দিলেন বোল্টকে, তিনি পাঠালেন উইকেটকিপারের কাছে। উইকেটকিপার স্টাম্প ভাঙার অনেক আগেই সূর্য রণে ভঙ্গ দিয়ে দিয়েছেন।
কোহলিই দায়ী, কিন্তু কোহলি ক্রিজে ছিলেন বলেই ভারত তখন চাপমুক্ত ছিল। ষষ্ঠ উইকেটে কোহলির সঙ্গী জাদেজাই তখন ভারতের শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান, কিন্তু 'চেইজ মাস্টার' কোহলি ক্রিজে ছিলেন - এর চেয়ে বড় স্বস্তি ভারতের জন্য আর কী হতে পারে! দুজনে গুবলেট পাকিয়ে ফেলার পরও বিশ্বকাপ অভিষেকে সূর্যকুমার তো আর এমনি এমনি নিজের উইকেট বিলিয়ে দেননি কোহলিকে ক্রিজে রাখার চেষ্টায়।
সেই কোহলি শেষ পর্যন্ত দারুণভাবে দলকে জিতিয়েই দিলেন। শেষ পর্যন্ত দলের জয়সূচক চার মেরে খেলা শেষ করে দেওয়া জাদেজা (৩৯) দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন, তবে কোহলি যেভাবে আস্কিং রানরেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রানের গতি ঠিক রেখেছেন, সেটা আরেকবার বুঝিয়ে দিল, কেন রানতাড়ায় কোহলিই সেরা।
শেষদিকে অবশ্য রানের চেয়ে বল বেশি বাকি দেখেই সেঞ্চুরির জন্য চেষ্টা করেছেন, যেমনটা বাংলাদেশের বিপক্ষেও করেছিলেন। ৪৬ ওভার শেষে ভারতের যখন ২৪ বলে ১৯ রান দরকার, কোহলির রান তখন ৮২, জাদেজার ৩৫। বোল্টের করা ৪৬তম ওভারের প্রথম বলেই দারুণ পুল শটে ছক্কা মেরে সেঞ্চুরির ইচ্ছা বুঝিয়ে দিলেন কোহলি। তৃতীয় বলে চার মেরে ঢুকে গেলেন নব্বইয়ের ঘরে। মাঝে বোল্ট একটা ওয়াইড দিলেন, পঞ্চম বলে সিঙ্গেল নিলেন কোহলি। শেষ বলে জাদেজা রান না নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, 'অ্যাসাইনমেন্ট'টা বুঝতে পেরেছেন তিনিও।
৪৭তম ওভারে হেনরির প্রথম বলে দুই রান নিয়ে ৯৫-এ পৌঁছালেন কোহলি, তৃতীয় বলে সিঙ্গেলের সুযোগ পেয়েও রান নেননি। পরের বলেই আউট! ভারত তখন জয় থেকে ৫ রান দূরে, কোহলিও সেঞ্চুরি থেকে ওই দূরত্বেই আউট। শামি-জাদেজার জয়ের সমীকরণটা মেলাতে লাগল ২ বল।
এর আগে ২৭৪ রানের লক্ষ্যে ভারতকে ঝোড়ো শুরু এনে দেন রোহিত ও গিল। রোহিত তো ইদানিং প্রথম দশ ওভারে নেমেই ঝড় তোলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, আজও ১২তম ওভারের প্রথম বলে লকি ফার্গুসনের বল স্টাম্পে টেনে এনে বোল্ড হওয়ার আগে ৪০ বলে ৪ চার ও ৪ ছক্কায় করলেন ৪৬ রান। কিন্তু দলকে ৭১ রানে রেখে রোহিতের বিদায়ের কিছুক্ষণ পরই ভারত আবার ধাক্কা খেল। ফার্গুসনের পরের ওভারেই অফ স্টাম্পের বাইরের বলে কাট করতে গিয়ে থার্ডম্যানে ক্যাচ তুলে দিয়ে বিদায় গিলের (৩১ বলে ৫ চারে ২৬)। ভারতের রান তখন ৭৬।
কোহলির সঙ্গে এরপর শ্রেয়াস আইয়ার কিছুক্ষণ ক্রিজে ছিলেন বটে। তবে ২৯ বলে ৬ চারে ৩৩ রান করে তিনি ট্রেন্ট বোল্টের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেন স্কয়ার লেগে। ভারত ১২৮/৩, কিন্তু তখনো চিন্তার কিছু নেই। কোহলি ততক্ষণে ক্রিজে সেট, তাঁর সঙ্গী হয়ে এলেন লোকেশ রাহুল।
কিন্তু এ জুটিও হতে হতে হলো না! ৫২ রানের জুটি গড়ার পর ৩৩তম ওভারে রাহুল এলবিডাব্লিউ হয়ে গেলেন মিচেল স্যান্টনারের বলে। তবু ভারতের অত 'টেনশন' হওয়ার কারণ ছিল না। কারণ, রাহুল আউট হওয়ার চার বল পরই - ৩৩তম ওভারের শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে ফিফটিতে পৌঁছে গেছেন কোহলি (৬০ বলে, ৫ চার ও ১ ছক্কায়)।
ফিফটিটা সেঞ্চুরিতে রূপ নিতে নিতেও নিল না। অবশ্য কোহলির এ নিয়ে আক্ষেপ খুব বেশি থাকার কথা নয়। নিউজিল্যান্ড ইনিংসে ড্যারিল মিচেলের দারুণ সেঞ্চুরি (১২৭ বলে ১৩০) যে এই ম্যাচে একটা 'ফুটনোট' হয়ে থাকছে!
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
নিউজিল্যান্ড : ৫০ ওভারে ২৭৩/১০ (কনওয়ে ০, ইয়ং ১৭, রবীন্দ্র ৭৫, মিচেল ১৩০, লাথাম ৫, ফিলিপস ২৩, চাপম্যান ৬, স্যান্টনার ১, হেনরি ০, ফার্গুসন ০, বোল্ট ০; বুমরাহ ১০-১-৪৫-১, সিরাজ ১০-১-৪৫-১, শামি ১০-০-৫৪-৫, জাদেজা ১০-০-৪৮-০, যাদব ১০-০-৭৩-২)
ভারত : ৪৮ ওভারে ২৭৪/৬ (রোহিত ৪৬, শুভমান ২৬, কোহলি ৯৫, শ্রেয়াস ৩৩, রাহুল ২৭, সূর্যকুমার ২, জাদেজা ৩৯, শামি ১; বোল্ট ১০-০-৬০-১, হেনরি ৯-০-৫৫-১, স্যান্টনার ১০-০-৩৭-১, ফার্গুসন ৮-০-৬৩-২, রবীন্দ্র ৯-০-৪৬-০, ফিলিপস ২-০-১২-০)
ফলাফল : ভারত চার উইকেটে জয়ী।