০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন, জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের সুর

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। শেষ পর্যন্ত দলগতভাবে নির্বাচনে আসেনি বিএনপি। বরং একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী রোববার ও সোমবার আবারও অবরোধ ঘোষণা করেছে দলটি।

অন্য দিকে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরোনো গৃহবিবাদ। দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নির্বাচনে আসেননি বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও তাঁর ছেলে সাদ এরশাদ। দলটির একাংশের আশঙ্কা, এই বিবাদকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি আবারও ভাঙনের মুখে পড়তে পারে।

বিএনপি নির্বাচনে না এলেও দলটির অনেক নেতাই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসছেন। নির্বাচনে আসতে অনেকেই আবার যোগ দিয়েছেন অন্য দলে। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এম শাহজাহান ওমরকে ঝালকাঠি–১ আসন থেকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী।

সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনসহ কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই অংশ নেয়নি দলটি। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবেন না তারা। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তাদের একটি বড় অংশকেই এরই মধ্যে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বিএনপি ভোট বর্জন করলেও দলটির অনেক নেতা–কর্মীই নির্বাচনে আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। শাহজাহান ওমর ছাড়াও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ. কে. একরামুজ্জামান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন তিনি।

এছাড়াও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মোহাম্মদ শোকরানা, সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি বেগম।

এর মধ্যে আখতারুজ্জামান কিশোরগঞ্জ–২ আসনের জন্য, শোকরানা বগুড়া–১, বিউটি বেগম বগুড়া–২ ও বাদল বগুড়া–৭ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

আখতারুজ্জামান ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ–২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর আগেও কয়েকবার তিনি দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন আবার ফিরেও এসেছেন। সর্বশেষ বহিষ্কার হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য দলীয় নেতাদের সমালোচনা করে।

দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে যাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ–তাঁতী বিষয়ক সম্পাদক রাবেয়া সিরাজ এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য মো. মাহাবুবুল হাসানও। তাদের দুজনকেই বহিষ্কার করেছে বিএনপি।

অন্যদিকে দলটির অনেক নেতা–কর্মীই নির্বাচনে প্রার্থী হতে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। এরই মধ্যে বিএনএমে যোগ দিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য সি.এম. সাফি মাহমুদ ও বিএনপিপন্থী সঙ্গীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনী।

এর আগে আরও পাঁচজন সাবেক সংসদ সদস্য বিএনএমে যোগ দিয়েছেন। এরা হলেন—জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, আবদুল ওহাব, আবু জাফর, দেওয়ান শামসুল আবেদীন, আবদুর রহমান।

এদিকে গত সেপ্টেম্বরে বিএনপির সাবেক দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারকে চেয়ারপারসন ও মহাসচিব করে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করে নতুন রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপি। এই দুই নেতার নেতৃত্বে তৃণমুল বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।

শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও। অবসরের পর ২০০৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। এর পরের বছরই দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হন।

আর তৈমুর আলম খন্দকার দীর্ঘসময় নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাও হন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটির প্রথম নির্বাচনের তিনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। ২০২২ সালে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

দলীয় কোন্দলের জেরে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। শেষ দিনেও মনোনায়ন জমা দেননি তিনি।

জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছাড়াও রওশন জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা। তিনি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী। দলের একটি অংশে তাঁর বেশ প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়।

গত সোমবার ২৮৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে জাতীয় পার্টি। এবার জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের দুটি আসন ঢাকা–১৭ এবং রংপুর–৩ থেকে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে রংপুর–৩ আসনে হওয়া উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তাঁর ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদ। ধারণা করা হয়েছিল, এবারও তিনি এই আসনে মনোনয়ন পাবেন। প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের জন্য ময়মনসিংহ-৪ আসন খালি রাখা হয়। কিন্তু পছন্দের আসনে মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচন করতে অস্বীকৃতি জানান রওশন এরশাদ ও সাদ এরশাদ।

রওশন নির্বাচনে না আসায় গত বুধবার রাতে এই আসনটিতে ময়মনসিংহ জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা সরকারকে মনোনয়ন দিয়েছে জাতীয় পার্টি।

জাতীয় পার্টির একাংশের নেতাদের অভিযোগ, দলে রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতা–কর্মীদের এবার নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক উপদেষ্টা গোলাম মসীহ জানান, রওশন এরশাদকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে ষড়যন্ত্র করেছেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

গোলাম মসীহ বলেন, ‘তাঁর আপন ঘরের লোকের জন্যই আজকে এই অবস্থা। তিনি (রওশন) বললেন যে, শেষ পর্যন্ত এতো চক্রান্ত হলো পার্টির ভেতরে যে আমি আগে কখনও হার মানিনি। শেষ পর্যন্ত দেবরের (জিএম কাদের) কাছে আমার হার মানতে হলো।’

অবশ্য দলটির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর দাবি, প্রধান পৃষ্ঠপোষককে নির্বাচনে আনতে সব চেষ্টাই তারা করেছেন।

চুন্নু বলেন, ‘ইলেকশন যদি তিনি (রওশন) না করেন সেখানে তো আমাদের কিছু করার নাই। আমরা কি করব? ম্যাডামের জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, উনি আসেন নাই। ওনার এই স্বাধীনতা আছে তিনি ইলেকশন করবেন কি করবেন না।’

জাতীয় পার্টিতে গৃহবিবাদ নতুন কিছু নয়। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে আসেন তাঁর ছোট ভাই জি এম কাদের। শুরু থেকেই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছিলেন রওশন। দুজনই নিজেদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেন। পরে অবশ্য সমঝোতার মাধ্যমে জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ও রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা করা হয়।

এরপর ২০২২ সালে আবারও দলের এই গৃহবিবাদ প্রকাশ্যে আসে। সে সময় এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ ছিল আওয়ামী লীগের সাথে জোটে থাকা-না থাকাকে কেন্দ্র করে। জি এম কাদেরপন্থীদের চাওয়া ছিল মহাজোট থেকে বের হয়ে বিএনপির সাথে বা আলাদা করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। অন্যদিকে রওশনপন্থীদের চাওয়া ছিল মহাজোটেই থেকে যাওয়া।

একপর্যায়ে ওই বছরের আগস্টে থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই রওশন এরশাদ কেন্দ্রীয় সম্মেলন ডাকেন। সে সময় রওশনের ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

জি এম কাদেরের চেয়ারম্যান পদে থাকাকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলাও করা হয়। এতে শুরুতে জি এম কাদেরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত। পরে অবশ্য উচ্চ আদালতের রায়ে চেয়ারম্যান পদ ফিরে পান জি এম কাদের।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মোট মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন ২ হাজার ৭৪১ জন প্রার্থী। সে হিসেবে ৩০০টি সংসদীয় আসনের প্রতিটিতে লড়বেন ৯ জনেরও বেশি প্রার্থী। বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র দাখিল শেষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়েছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৩০০টি সংসদীয় আসনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন পর্যন্ত ২ হাজার ৭৪১ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। মোট দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র সমূহে ৩০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে।

নির্বাচনে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রার্থীদের পাশাপাশি দলটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা–কর্মী এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে আসছেন। আর ২৮৮টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি। এবারই নির্বাচনে প্রথম আসা তৃণমুল বিএনপির প্রার্থীরা ২৩০ আসনে নির্বাচন করছেন।

এছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৯০ প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য তিন মন্ত্রীসহ ১৫ প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে ইসি।

গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তফসিল অনুযায়ী ভোট হবে আগামী ৭ জানুয়ারি।

এছাড়াও মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ৩০ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর আর প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। প্রচারণা শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে। চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত।

শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন, জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের সুর

আপডেট : ০৫:২৯:৫৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। শেষ পর্যন্ত দলগতভাবে নির্বাচনে আসেনি বিএনপি। বরং একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী রোববার ও সোমবার আবারও অবরোধ ঘোষণা করেছে দলটি।

অন্য দিকে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরোনো গৃহবিবাদ। দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নির্বাচনে আসেননি বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও তাঁর ছেলে সাদ এরশাদ। দলটির একাংশের আশঙ্কা, এই বিবাদকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি আবারও ভাঙনের মুখে পড়তে পারে।

বিএনপি নির্বাচনে না এলেও দলটির অনেক নেতাই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসছেন। নির্বাচনে আসতে অনেকেই আবার যোগ দিয়েছেন অন্য দলে। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এম শাহজাহান ওমরকে ঝালকাঠি–১ আসন থেকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী।

সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনসহ কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই অংশ নেয়নি দলটি। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবেন না তারা। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তাদের একটি বড় অংশকেই এরই মধ্যে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বিএনপি ভোট বর্জন করলেও দলটির অনেক নেতা–কর্মীই নির্বাচনে আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। শাহজাহান ওমর ছাড়াও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ. কে. একরামুজ্জামান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন তিনি।

এছাড়াও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মোহাম্মদ শোকরানা, সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি বেগম।

এর মধ্যে আখতারুজ্জামান কিশোরগঞ্জ–২ আসনের জন্য, শোকরানা বগুড়া–১, বিউটি বেগম বগুড়া–২ ও বাদল বগুড়া–৭ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

আখতারুজ্জামান ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ–২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর আগেও কয়েকবার তিনি দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন আবার ফিরেও এসেছেন। সর্বশেষ বহিষ্কার হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য দলীয় নেতাদের সমালোচনা করে।

দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে যাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ–তাঁতী বিষয়ক সম্পাদক রাবেয়া সিরাজ এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য মো. মাহাবুবুল হাসানও। তাদের দুজনকেই বহিষ্কার করেছে বিএনপি।

অন্যদিকে দলটির অনেক নেতা–কর্মীই নির্বাচনে প্রার্থী হতে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। এরই মধ্যে বিএনএমে যোগ দিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য সি.এম. সাফি মাহমুদ ও বিএনপিপন্থী সঙ্গীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনী।

এর আগে আরও পাঁচজন সাবেক সংসদ সদস্য বিএনএমে যোগ দিয়েছেন। এরা হলেন—জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, আবদুল ওহাব, আবু জাফর, দেওয়ান শামসুল আবেদীন, আবদুর রহমান।

এদিকে গত সেপ্টেম্বরে বিএনপির সাবেক দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারকে চেয়ারপারসন ও মহাসচিব করে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করে নতুন রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপি। এই দুই নেতার নেতৃত্বে তৃণমুল বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।

শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও। অবসরের পর ২০০৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। এর পরের বছরই দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হন।

আর তৈমুর আলম খন্দকার দীর্ঘসময় নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাও হন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটির প্রথম নির্বাচনের তিনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। ২০২২ সালে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

দলীয় কোন্দলের জেরে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। শেষ দিনেও মনোনায়ন জমা দেননি তিনি।

জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছাড়াও রওশন জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা। তিনি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী। দলের একটি অংশে তাঁর বেশ প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়।

গত সোমবার ২৮৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে জাতীয় পার্টি। এবার জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের দুটি আসন ঢাকা–১৭ এবং রংপুর–৩ থেকে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে রংপুর–৩ আসনে হওয়া উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তাঁর ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদ। ধারণা করা হয়েছিল, এবারও তিনি এই আসনে মনোনয়ন পাবেন। প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের জন্য ময়মনসিংহ-৪ আসন খালি রাখা হয়। কিন্তু পছন্দের আসনে মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচন করতে অস্বীকৃতি জানান রওশন এরশাদ ও সাদ এরশাদ।

রওশন নির্বাচনে না আসায় গত বুধবার রাতে এই আসনটিতে ময়মনসিংহ জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা সরকারকে মনোনয়ন দিয়েছে জাতীয় পার্টি।

জাতীয় পার্টির একাংশের নেতাদের অভিযোগ, দলে রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতা–কর্মীদের এবার নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক উপদেষ্টা গোলাম মসীহ জানান, রওশন এরশাদকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে ষড়যন্ত্র করেছেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

গোলাম মসীহ বলেন, ‘তাঁর আপন ঘরের লোকের জন্যই আজকে এই অবস্থা। তিনি (রওশন) বললেন যে, শেষ পর্যন্ত এতো চক্রান্ত হলো পার্টির ভেতরে যে আমি আগে কখনও হার মানিনি। শেষ পর্যন্ত দেবরের (জিএম কাদের) কাছে আমার হার মানতে হলো।’

অবশ্য দলটির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর দাবি, প্রধান পৃষ্ঠপোষককে নির্বাচনে আনতে সব চেষ্টাই তারা করেছেন।

চুন্নু বলেন, ‘ইলেকশন যদি তিনি (রওশন) না করেন সেখানে তো আমাদের কিছু করার নাই। আমরা কি করব? ম্যাডামের জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, উনি আসেন নাই। ওনার এই স্বাধীনতা আছে তিনি ইলেকশন করবেন কি করবেন না।’

জাতীয় পার্টিতে গৃহবিবাদ নতুন কিছু নয়। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে আসেন তাঁর ছোট ভাই জি এম কাদের। শুরু থেকেই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছিলেন রওশন। দুজনই নিজেদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেন। পরে অবশ্য সমঝোতার মাধ্যমে জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ও রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা করা হয়।

এরপর ২০২২ সালে আবারও দলের এই গৃহবিবাদ প্রকাশ্যে আসে। সে সময় এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ ছিল আওয়ামী লীগের সাথে জোটে থাকা-না থাকাকে কেন্দ্র করে। জি এম কাদেরপন্থীদের চাওয়া ছিল মহাজোট থেকে বের হয়ে বিএনপির সাথে বা আলাদা করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। অন্যদিকে রওশনপন্থীদের চাওয়া ছিল মহাজোটেই থেকে যাওয়া।

একপর্যায়ে ওই বছরের আগস্টে থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই রওশন এরশাদ কেন্দ্রীয় সম্মেলন ডাকেন। সে সময় রওশনের ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

জি এম কাদেরের চেয়ারম্যান পদে থাকাকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলাও করা হয়। এতে শুরুতে জি এম কাদেরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত। পরে অবশ্য উচ্চ আদালতের রায়ে চেয়ারম্যান পদ ফিরে পান জি এম কাদের।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মোট মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন ২ হাজার ৭৪১ জন প্রার্থী। সে হিসেবে ৩০০টি সংসদীয় আসনের প্রতিটিতে লড়বেন ৯ জনেরও বেশি প্রার্থী। বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র দাখিল শেষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়েছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৩০০টি সংসদীয় আসনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন পর্যন্ত ২ হাজার ৭৪১ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। মোট দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র সমূহে ৩০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে।

নির্বাচনে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রার্থীদের পাশাপাশি দলটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা–কর্মী এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে আসছেন। আর ২৮৮টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি। এবারই নির্বাচনে প্রথম আসা তৃণমুল বিএনপির প্রার্থীরা ২৩০ আসনে নির্বাচন করছেন।

এছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৯০ প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য তিন মন্ত্রীসহ ১৫ প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে ইসি।

গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তফসিল অনুযায়ী ভোট হবে আগামী ৭ জানুয়ারি।

এছাড়াও মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ৩০ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর আর প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। প্রচারণা শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে। চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত।