মানিকগঞ্জ-২ (সিঙ্গাইর-হরিরামপুর এবং সদরের তিনটি ইউনিয়ন) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের গত পাঁচ বছরে আয় বেড়েছে ১ দশমিক ৬০ গুণ। এ সময়ে তাঁর মোট সম্পদ বেড়েছে ১ দশমিক ২৭ গুণ।
গত পাঁচ বছরে তাঁর সম্পদ ও আয় দুটোই বাড়লেও,বাড়েনি নগদ অর্থের পরিমাণ। ঋণের পরিমাণ কমলেও রয়েছে কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি। এছাড়া দুটি ফোজদারি মামলার আসামিও তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামা ও তার আয়-ব্যয় সংক্রন্ত তথ্য বিরবণী বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেওয়া মমতাজ বেগমের হলফনামার তথ্য বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তাঁর বাৎসরিক আয় ছিল ৩৮ লাখ ৮৪ হাজার ২৭৬ টাকা। বর্তমানে তাঁর আয় দেখোনো হয়েছে ৪৯ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৮ টাকা। এর মধ্যে পেশা থেকে আয় ৭ লাখ টাকা, কৃষি খাত থেকে ৩ লাখ টাকা, বাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট আর দোকান ভাড়া থেকে ১০ লাখ ৮২ হাজার ৯৯৭ টাকা এবং শেয়ার সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক আমানত থেকে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯১ টাকা আয় দেখানো হয়েছে।
অন্যদিকে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় মমতাজের আয় ছিল ৭৯ লাখ ২৬ হাজার ৮৩৪ টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাতে ৭০ হাজার, ব্যবসা থেকে ১০ লাখ ৮৪ হাজার ৯৫৩ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৩০ লাখ, ব্যক্তিগত পেশা থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার আর অন্যান্য থেকে ৩৪ লাখ ৪১ হাজার ৮৮১ টাকা আয় দেখিয়েছিলেন। তবে সে সময় বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট অথবা দোকান বা অন্যান্য এই খাতে কোনো আয়ই ছিল না মমতাজের।
হলফনামা অনুযায়ী, সংসদ সদস্য ভাতা ও আনুষঙ্গিক পারিতোষিক বাবদ মমতাজ বছরে আয় করেন ১৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসাবে মমতাজ বেগমের হাতে আছে নগদ ৫ লাখ টাকা, তাঁর স্বামীর নামেও নগদ অর্থ আছে ৫ লাখ টাকা। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হলফনামাও তাঁর নগদ টাকা ছিল ৫ লাখ আর স্বামী নামে ছিল ২ লাখ । কিন্তু ২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচনে নগদ অর্থ ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টাকা আর স্বামীর নামে কোনো টাকাই ছিল না।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে তাঁর জমা অর্থের পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ২১৮ টাকা। স্বামীর নামে ১৮ লাখ। যা ২০১৮ সালের নির্বাচনের হলফনামায় ছিল ৮৬ লাখ ৯৯ হাজার ১৯৭ টাকা এবং ২০১৪ সালের হলফনামায় ছিল ৩০ লাখ টাকা এবং স্বামীর নামে ছিল ২০ লাখ টাকা।
মধু উজালা কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের ৩ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের শেয়ার আছে মমতাজের। সঞ্চয়পত্র আছে ৪৫ লাখ টাকার। মমতাজের নামে গাড়ি আছে তিনটি। ল্যান্ডক্রুজার নামে একটি গাড়ির দাম ১ কোটি ৩ লাখ ১২ হাজর ৫০০ টাকা। এ ছাড়া ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮ মডেলের গাড়ির দাম ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ২৮ লাখ টাকা মূল্যের টয়োটা হাইয়েস আছে। আর স্বামীর ৮ লাখ টাকা মূল্যের একটি ১৩০০সিসি ফান কার্গো গাড়ি রয়েছে। আর ২০১৪ সালের হলফনামায় তার স্বামীর নামের কোনো গাড়ি দেখাননি। নির্ভরশীলদের নামে মধু উজালা কোল্ড স্টোরেজের শেয়ার আছে ৬৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকার।
কৃষি জমি না বাড়লেও পাঁচ বছরে মমতাজের ৭০০ শতাংশ অকৃষি জমি কমেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে হলফনামা অনুযায়ী তার অকৃষি জমি ছিল ১২০০ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০০ শতাংশে। আর ২০১৪ সালের হলফনামা অনুযায়ী অকৃষি জামির পরিমাণ ছিল ৫ কাটা, যার মূল্য ছিল ৫ কোটি টাকা।
মহাখালীতে ৫ তলাবিশিষ্টি একটি বাড়ি রয়েছে মমতাজের যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ৯৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা আর সিংগাইরের জয়মন্টপ এলাকায় ২ তলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি আছে মমতাজের। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৫৭ লাখ ৫ হাজার ৪৪০ টাকা।
অন্যদিকে, ২০১৪ সালের হলফনামা অনুযায়ী তাঁর নিজ নামে কোনো বাড়ির তথ্য ছিল না। তবে নিজ নামে একটি কোল্ড স্টোরেজ ছিল, যার মূল্য ছিল ৯০ লাখ টাকা। হলফনামায় নিজের পরিচয়ে মৃত বাবার নাম উল্লেখ থাকলেও মমতাজের স্বামীর নামে নগদ ৫ লাখ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ১৮ লাখ টাকা এবং ১৩০০ সিসি ফান কার্গো নামে একটি গাড়ি দেখানো হয়েছে। গাড়িটির মূল্য ৮ লাখ টাকা।
৫ বছরে প্রায় ৫২ লাখ ৫৩ হাজার টাকার ঋণের পরিমাণ কমেছে মমতাজের। ২০১৮ সালে মমতাজের ব্যাংক ঋণ ছিল ৩ কোটি ৩৪ লাখ ১১ হাজার ৪৬৪ টাকা। ২০২৩ সালের হলফনামায় ব্যাংক ঋণ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৮১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। আর ২০১৪ সালের হলফনামায় ব্যক্তিগত ঋণ দেখিয়েছিলেন ৪০ লাখ টাকা।
হলফনামা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মমতাজের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও ভারতের বহরমপুর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতে এবং কলকাতার হাইকোর্টে মমতাজের বিরুদ্ধে দুটি প্রতারণার মামলা চলমান আছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসনে যাচাই-বাছাই শেষে ১৪ জন প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমসহ ৯ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা রেহেনা আকতার।
তবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া প্রার্থীদের তথ্যের গড়মিল রয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন মানিকগঞ্জ জেলার সহ-সভাপতি ইকবাল হোসেন কচি। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীরা যে হলফনামা জমা দিয়েছেন তার সঙ্গে বাস্তবের তথ্য কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হয় হলফনামার সত্য নয়। এসব বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের নির্বিকার দেখা যাচ্ছে। কেন প্রার্থীদের তারা এ বিষয়ে প্রশ্ন করছে না এটাও বোধগম্য নয়।’
মানিকগঞ্জের তিনটি আসনে ২১ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে। তবে মনোনয়নপত্রে ত্রুটি আর ঋণ খেলাপির কারণে ১২ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায় যাচাই-বাছাইয়ে।