ভিক্ষা করে চলে মুক্তিযোদ্ধার সংসার
- আপডেট সময় : ০৬:২৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩
- / ৪২৯ বার পড়া হয়েছে
শেরপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক ও অস্ত্র তৈরির কারিগর শহীদ আবু তালেবের ছেলেদের নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। ভূমিহীন অবস্থায় অন্যের বাড়িতে রাত কাটাতে হয়। গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাবার নাম থাকলেও এখনো তাঁদের হাতে পৌঁছেনি স্বীকৃতিপত্র। পাচ্ছেন না কোনো সুযোগ–সুবিধাও। তাই ভিক্ষা করেই চলে জীবন।
শেরপুর জেলার তৎকালীন নবীনচরের আবু তালেব চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পালিয়ে আসেন এলাকায়, শুরু করেন কামারের কাজ। তৈরি করতে থাকেন অস্ত্র ও বিস্ফোরক। এসব অস্ত্র দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। এরই মধ্যে এ খবর চলে যায় পাক হানাদারদের কাছে। তারা আবু তালেবকে ধরে আহাম্মদ নগর নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে।
আবু তালেব শহীদ হওয়ার পর থেকেই তাঁর পরিবারে নেমে আসে কষ্ট। দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে খুব দুর্ভোগে পড়েন আবু তালেবের স্ত্রী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বড় ছেলে ইদ্রিস আলী শেরপুর সদর থানায় লাশ টানার কাজ শুরু করেন। একই সাথে বাবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নানা আবেদন–নিবেদন শুরু করেন।
সরকার আবু তালেবের নাম ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু এখনো পরিবারের হাতে এসে পৌঁছেনি আবু তালেবের বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপত্র। তাঁর পরিবার পাচ্ছে না মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ–সুবিধা।
বার্ধক্যের কারণে শরীর দুর্বল হওয়ায় এখন লাশ বহন করতে পারেন না ইদ্রিস আলী। রোজগার করতে না পারায় ভিক্ষা করেই চলছে সংসার। আর ভিটের সামান্য জায়গাও বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন অন্যের বাড়িতে রাত কাটাতে হয় তাঁদের। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করেও মেলেনি মাথা গোঁজার ঠাঁই।
মৃত্যুর আগে কি বাবার ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতির সনদ পাবেন—শেষ বয়সে এসে এই প্রশ্নই করে যাচ্ছেন ইদ্রিস আলী।
এলাকাবাসী বলছে, কত মানুষ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে নানাভাবে সুযোগ–সুবিধা নিচ্ছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে শহীদের পরিবারকে ভিক্ষা করে পরের বাড়িতে দিন কাটাতে হয়। তারা দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়।
শহীদ তালেবের ছেলে ইদ্রিস আলী জানান, ‘আমার বাবা সেনাবাহিনীর চাকরি করত। সেখান থেকে চলে এসে কামারের কাজ করত, আর অস্ত্র বানাইতো। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং করাইত। দাদি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ইন্ডিয়ায় যেতে পারে নাই। পরে পাকবাহিনীরা আর রাজাকারেরা আইসা ধইরা নিয়ে বাবারে নির্যাতন করে গুলি করে মাইরা ফেলায়। আমরা খুব কষ্ট করছি। লাশ টানার কাজ করছি। শরীরে শক্তি নাই। এহন চাইয়া–টাইয়া খাই। একটু জায়গা আছিল, তাও বেইচা ফেলাইছি। এহন মাইনষের বাড়িতে থাহি।’
ইদ্রিস আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘কত জায়গায় ঘুরলাম একটা ঘরের লাইগা, তাও কেউ দিল না। গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম উঠছে। টেহা খরচ করবার পাই না, তাই স্বীকৃতি পেলাম না; সুযোগ–সুবিধা পেলাম না। মরার আগে আর মনে হয় স্বীকৃতি পামু না।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা দুলাল হাজী জানান, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল চালানো, গ্রেনেড ছোড়া ও আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর প্রশিক্ষণ দিতেন। হঠাৎ একদিন ভোরে আবু তালেবকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী। নির্যাতনের পর কাঁটখালী ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে এই যোদ্ধাকে।’
দুলাল হাজী আরও জানান, শহীদ আবু তালেবের নাম মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও রয়েছে। শেরপুর সদর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকাতেও তিন নম্বরে পাওয়া যায় তাঁর নাম।
এলাকার হাকিম বাবুল জানান, দারিদ্র্যের কারণে আবু তালেবের ভূমিহীন পরিবারটির জোটে না তিনবেলা খাবার। নবীনগর চার রাস্তার মোড়ে সরকারি খরচে শহীদ আবু তালেব স্মৃতিস্তম্ভ ও শহীদ আবু তালেব পাঠাগার তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর পরিবার কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় হতাশ এলাকাবাসী। তারা চান, পুনর্বাসন করা হোক শহীদ আবু তালেবের পরিবারের সদস্যদের।
শেরপুর জেলা ঘাতক–দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আখতারুজ্জামান জানান, ‘আমরা যার কাছে ট্রেনিং নিয়েছি, তার পরিবারকে পুনর্বাসন করা জরুরি। আমরা চাই এ পরিবারটিকে আর্থিক সহযোগিতা করা হোক।’
শেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নূরুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে না পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। দ্রুত শহীদ আবু তালেবের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি সনদ তাঁর পরিবার পাবে—এমনটাই প্রত্যাশা।’