দেশের কর্মজীবী মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশ অবসরোত্তর আর্থিক নিরাপত্তা পান। কর্মজীবীদের একটি বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এ ছাড়া সরকারি ছাড়া বেসরকারি খাতের কর্মীদেরও এমন কোনো আর্থিক নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। তাদের জন্য এ বছরের সবচেয়ে বড় সুসংবাদ ছিল সর্বজনীন পেনশন স্কিম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বছরের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন করেন। এরপরই এটি নিয়ে নানা মহলে নানা আলোচনা হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ শেষ পর্যন্ত বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছেন।
দেশের বয়োবৃদ্ধদের শেষ জীবনে চলার সম্বল, নিরাপত্তা, মানসিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার লক্ষ্যেই এ স্কিম। সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের বয়স ১৮ বছরের বেশি হলেই পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার শুরুর দিকের যাত্রা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে একটি অংশগ্রহণমূলক পেনশন ব্যবস্থার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এরপর ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়া ইশতেহারে সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য পেনশন স্কিমের ঘোষণা দেয়। ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন।
পরে গত বছরের ৯ জুন জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশের জনগণের বেকারত্ব, ব্যাধি, পঙ্গুত্ব, বার্ধক্যজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততা এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি পেনশন এবং সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে অর্থ বিভাগ ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল ২০২২’–এর রূপরেখা তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। একই মাসের ২০ তারিখে এই আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। পরে ২৯ আগস্ট এটি জাতীয় সংসদে তোলা হয়। এরপর ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাসের প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী। কণ্ঠভোটে তা পাসও হয়। বিলটি পরে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হয়।
রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এ বছরেরই ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন এই পেনশন স্কিমের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। সেদিন থেকেই শুরু হয় নিবন্ধন। দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু হয় এটি।
সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আসতে পারবেন। এ কর্মসূচির অংশ হতে জাতীয় পরিচয়পত্র আবশ্যক। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তারা চাইলে পাসপোর্ট দিয়েও নিবন্ধন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে তার কপি জমা দিতে হবে।
আবার যাদের বয়স ৫০ বছরের বেশি হয়ে গেছে তারাও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে টানা ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পর পেনশন পাবেন তাঁরা।
সরকার ঘোষিত ছয়টি স্কিমের মধ্যে চারটি নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে। পরে সুবিধাজনক সময়ে আরও দুটি স্কিম চালু করা হবে। চালু স্কিমগুলো হলো—বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের জন্য ‘সুরক্ষা’, বিদেশে থাকাদের জন্য ‘প্রবাসী’ এবং অতি দরিদ্রদের জন্য ‘সমতা’।
প্রবাস স্কিম: বিদেশে অবস্থানকারী বা কর্মরত যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক তফসিলে বর্ণিত চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দিয়ে এই স্কিমের আওতায় আসতে পারেন।
প্রগতি স্কিম: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো কর্মচারী বা উক্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক তফসিলে বর্ণিত হারে চাঁদা দিয়ে প্রগতি স্কিমে অংশ নিতে পারেন। এই স্কিমের ক্ষেত্রে চাঁদার ৫০ শতাংশ কর্মচারী ও অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান দেবে। তবে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই স্কিমে অংশ না নিলে, প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো কর্মচারী স্ব–উদ্যোগে এককভাবে এই স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
সুরক্ষা স্কিম: অনানুষ্ঠানিক খাত বা নিজ কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা; যেমন-কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে ইত্যাদি পেশাজীবীরা তফসিলে বর্ণিত হারে চাঁদা দিয়ে এই স্কিমের আওতায় আসতে পারেন।
সমতা স্কিম: আয়সীমার ভিত্তিতে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে (যাদের বর্তমান আয় বার্ষিক ৬০ হাজার টাকার কম) তফসিলে বর্ণিত হারে চাঁদা দিয়ে তাঁরা এই স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনা ও বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা অর্থ বিভাগের আওতাধীন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট চালু হয়েছে চলতি বছরের ১৬ আগস্ট। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের জন্য প্রথমে যেতে হবে এই ওয়েবসাইটে। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর এবং ই-মেইল ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য দিয়ে অনলাইন ফরম পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া সরাসরি সোনালী ব্যাংকের যেকোনো শাখায় গিয়েও পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করা যাবে, দেওয়া যাবে চাঁদাও। মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও চাঁদা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। মাসে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেওয়া যাবে। কমপক্ষে ১০ বছর টাকা জমা দিতে হবে পেনশন সুবিধা পাওয়ার জন্য।
সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আমৃত্যু পেনশন সুবিধা পাওয়া যাবে। নির্ধারিত পরিমাণ চাঁদা দেওয়ার পর যদি গ্রাহক মারা যান, তাঁর উত্তরাধিকারী এই পেনশন পাবেন ১৫ বছর। তবে ১৮ বছর বয়সে যদি কোনো বেসরকারি নাগরিক এই কর্মসূচিতে যুক্ত হন, তবে তিনি সুবিধা পাবেন সবচেয়ে বেশি। বয়স যত বাড়বে, আনুপাতিক হারে সুবিধা তত বাড়বে।
৭৫ বছর বয়সের আগে যদি কোনো পেনশনার মারা যান তাহলে তাঁর নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের পেনশন পাবেন। আর ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে কোনো পেনশনার মারা গেলে জমা অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে দেওয়া হবে। এ ছাড়া কোনো প্রয়োজনে চাঁদার আবেদনের ভিত্তিতে জমা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নেওয়া যাবে। পরে নির্ধারিত ফিসহ তা পরিশোধ করতে হবে। পেনশনের চাঁদা বিনিয়োগ বিবেচনায় কর রেয়াতযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মাসিক পেনশন বাবদ পাওয়া অর্থ থাকবে আয়করমুক্ত।
তবে যদি কেউ ধারাবাহিকভাবে তিনবার চাঁদা পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার পেনশন হিসাব স্থগিত হবে। পরবর্তীতে বকেয়া কিস্তি পরিশোধ না করা পর্যন্ত হিসাবটি আর খোলা হবে না। এ ছাড়া নির্দিষ্ট তারিখে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী এক মাস পর্যন্ত জরিমানাবিহীন পরিশোধ করা যাবে। কেউ চাইলে আগাম কিস্তিও পরিশোধ করতে পারবেন।
তবে পেনশন স্কিম নিয়ে অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন, শেষ পর্যন্ত টাকাটা পাওয়া যাবে তো?
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এটা নিয়ে শঙ্কা থাকার কোনো কারণ নেই। কারণ সরকার নিজে এটার গ্যারান্টি দিচ্ছে।’