২০২৩ : যুদ্ধ ও মৃত্যুর বাস্তবতায় বন্দী পৃথিবী
- আপডেট সময় : ০৫:৩৫:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩
- / ৪০৮ বার পড়া হয়েছে
করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই বন্দী থেকে বিশ্ববাসী চেয়ে চেয়ে দেখেছে নিজেদের সর্বনাশ। দৃশ্যমান মানুষ দেখেছে প্রায় অদৃশ্য এক ভাইরাসের শক্তি। অনেকের শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস।
তবুও যখন এর প্রকোপ কমেছিল, বিশ্ব কিছুটা হলেও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এবার তাহলে অন্তত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাটা করা যাবে।
কিন্তু সেই চেষ্টা কি আর করা গেল? গোছানোর আগেই ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’।
নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘একটা ফুলকির জন্যে’ কবিতার পঙ্ক্তির মতোই ভীষণ রাগে যুদ্ধ শুরু হলো। অস্ত্রের ঝলকানি, বোমার আঘাত, কামানের গোলার ক্ষিপ্রতা ছাপিয়ে আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট, অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। আর পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি তো আছেই।
শুরুটা গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। এই আগ্রাসনকে বেশ কয়েকবার নিজেই ‘যুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাতে বিশ্ব দুই ভাগ হয়ে গেল। ইউক্রেনে একের পর এক সহায়তার ঘোষণা দিল আমেরিকা ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো। সরাসরি ঘোষণা না দিলেও রাশিয়ার পক্ষ নিল ইরান ও উত্তর কোরিয়া। চীনকেও পাশে পেল রাশিয়া।
শ্যাম্পেইনের বোতল হাতে নতুন বার্তা দিয়ে বছরটা শুরু করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। সেই বার্তায় রাশিয়াকে বিভক্ত করার জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করেন তিনি। এর আগেই অবশ্য কিয়েভে বিমান হামলার মাধ্যমে ইউক্রেনকে নববর্ষের বার্তা দেয় রাশিয়া। তাতে বেশ কয়কজন আহত হয়।
এর জবাবে রুশ বাহিনীর দখলে থাকা দনেৎস্ক অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ৪০০ রুশ সেনা নিহতের দাবি করে ইউক্রেন। রাশিয়ার পক্ষ থেকে হতাহতের বিষয়টি স্বীকার করা হলেও নিহতের সংখ্যা জানানো হয়নি। এরপর ৫ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন পুতিন। তবে হামলা কিন্তু থেমে থাকেনি। আর ২০২২ সালের মতো এ বছরও ইউক্রেনে সহায়তা দিতে শুরু করে আমেরিকা ও ন্যাটো।
গত ৯ জানুয়ারি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বড় ধরনের হামলা চালানোর দাবি করে রাশিয়া। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, এই হামলায় ছয় শতাধিক ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হয়েছে। এর মধ্যেই ইউক্রেন প্রতিরোধের দাবি করে। দেশটি জানায়, তারা দনবাস অঞ্চলে রুশ বাহিনীকে রুখে দিয়েছে। জানুয়ারিতে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় লবণখনি সমৃদ্ধ শহর সোলেদারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করে রাশিয়া। জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শুরু হয় হামলা।
এরপর বছরজুড়েই হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। আর ইউক্রেন প্রতিহত করেছে। তবে এবার রাশিয়াতেও বেশ কয়েকবার হামলা চালানোর দাবি করেছে ইউক্রেন। এমনকি রুশ জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ছবিও প্রকাশ করা হয়।
সবকিছু ছাপিয়ে এই ইস্যুতে বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় ‘ওয়াগনারের বিদ্রোহ ও দমন’। গত জুনে রাশিয়ার প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দেয় দেশটির ভাড়াটে এই সেনাদল। সংস্থাটি জানায়, রুশ নেতৃত্ব পতনের জন্য তারা সব ধ্বংস করে দেবে। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার অডিও বার্তাও দেন ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন।
কিন্তু তা আর হয় না। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় সেই বিদ্রোহ থামানো হয়। আর গত আগস্টে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন প্রিগোজিন। পুতিন ফেলেন স্বস্তির নিঃশ্বাস।
অক্টোবরে হামাস–ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর এই যুদ্ধ কিছুটা আবেদন হারায়। এর মধ্যেই দেশটিতে সহায়তা দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি একমত হতে ব্যর্থ হয় আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এর আগেই অবশ্য পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
আমেরিকার থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিল বলছে, এ বছরও যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো আভাসই মেলেনি। অন্তত ২০২৪ সালেও যুদ্ধ চলবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে যুদ্ধের ভয়াবহতা কমতে পারে। কেননা এরই মধ্যে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ কমতে শুরু করেছে। রাশিয়ার ভান্ডারও ফুরিয়ে আসছে। উত্তর কোরিয়া ও ইরানের দিকে তাকিয়ে আছেন পুতিন। ন্যাটোর জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা অ্যাডমিরাল রব বাউয়ার বলছেন, ‘ব্যারেলের নিচের অংশটি এখন দৃশ্যমান।’
মাত্র ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট এসে আঘাত হানে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে যা হলো, তা গোটা বিশ্বকেই অবাক করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের এই রকেট হামলায় এ পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেদিন ‘বীরদর্পে’ হামলা চালায় হামাস।
তবে এ জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। হামাসের হামলার জবাবে গাজায় একের পর এক বোমা হামলা করতে থাকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। একসময় স্থল অভিযান শুরু হয়। হামলা থেকে বাদ যায়নি হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
হামাসকে নির্মূলের কথা বলে ইসরায়েলের চলমান এই হামলায় ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ মাসে প্রায় ১৬ হাজার নিরীহ মানুষ মারা যায়। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। সংবাদ সংস্থা আনাদুলু বলছে, নিহতদের ৬০ শতাংশ নারী ও শিশু। ঘরছাড়া হয় লাখো গাজাবাসী। স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র ও হাসপাতাল পরিণত হয় কবরস্থানে।
গত নভেম্বরের শেষদিকে কাতারের মধ্যস্থতায় ৭ দিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় হামাস ও ইসরায়েল। এতে জিম্মি করা ২৪০ জনের মধ্যে ১০৫ জনকে মুক্তি দেয় হামাস। এর বিনিময়ে ইসরায়লি কারাগার থেকে মুক্তি পায় ২৪০ জন ফিলিস্তিনি।
যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর আবারও হামলা জোরদার করতে থাকে ইসরায়েল। এর মধ্যে একদিনেই নিহত হয় ৭ শতাধিক ফিলিস্তিনি। আর মাঝে মাঝে হামাসের হামলার খবর পাওয়া যায়। লেবানন সীমান্তে রয়েছে আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর তৎপরতা।
ইসরায়েলের পক্ষে রয়েছে আমেরিকা। যুদ্ধবিরতিতে ভেটো দিয়েই যাচ্ছে তারা। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে পাশে। আরব নেতারা এর বিরোধিতা করছেন। তবে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নেই কোনো দেশই।
এ তো গেল বড় দুই যুদ্ধের কথা। কিন্তু যুদ্ধ তো আরও চলছে। এই যেমন পাশের দেশ মিয়ানমারে সেনা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়ে যাচ্ছে বিদ্রোহীরা। আছে আর্মেনিয়া–আজারবাইজান অঞ্চলে নাগোর্নো–কারাবাখ নিয়ে ফের শুরু হওয়া যুদ্ধ। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র সংঘাতের দিকে নজর রাখা ও এসম্পর্কিত তথ্য দেওয়া ওয়েসাইটগুলো জানাচ্ছে—সরাসরি যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলা ইত্যাদি মিলিয়ে বিশ্বের ৩২টি দেশ বর্তমানে সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে রয়েছে।
এর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য সংঘাত চলছে আলজেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, চাদ, কঙ্গো, ঘানা, আইভরি কোস্ট, নাইজার, সুদান, তানজানিয়া, টোগো, তিউনেশিয়া, উগান্ডা, ইয়েমেন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান, মালি, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, ইথিওপিয়ায়। গাজা ও ইউক্রেনের কথা আগেই বলা হয়েছে।
ইয়েমেনে এখন জাতিসংঘের চেষ্টায় হওয়া শান্তি কার্যকর হলেও উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। একই অবস্থা ইথিওপিয়ায়। যেকোনো সময় আবার সরাসরি যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
বছরজুড়ে যুদ্ধ। করোনার পর এই যুদ্ধও যেন আরেক মহামারিতে রূপ নিয়েছে, যার কোনো সমাপ্তির দেখা নেই। একদিকে নিজেদের স্বাধীন করতে লড়ছে হামাস। আরেকদিকে হামাসকে নির্মূল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইসরায়েল। আর জাতিসংঘসহ সবাই বলে আসছে দ্বিরাষ্ট্র নীতির প্রয়োজনীয়তার কথা। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
মাঝে থেকে যা ক্ষতি হওয়ার, তা হচ্ছে সাধারণ মানুষের। হাজার হাজার শিশু মারা পড়ছে। জন্মেই তারা দেখছে মানুষে–মানুষে হিংসা। এক ইউক্রেন যুদ্ধেই কত মানুষ মারা গেছে। গাজাতেও সেই ভয়াবহতা। ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে বাজারেও অস্থির পরিস্থিতি ক্রমে লাগামছাড়া হচ্ছে। প্রবাদের সেই কথাটাই বারবার ফিরে আসে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’।