খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসব বড়দিনে সবচেয়ে উৎসবমুখর থাকে যিশুর জন্মস্থান বেথেলহেম। কিন্তু আজ সোমবার সেই বেথেলহেমের শহর, রাস্তা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমল—সব পড়ে আছে উৎসবহীন। নেই কোনো পর্যটক কিংবা তীর্থযাত্রী।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় ইরেজ সীমান্তে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। এরপর ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। পরে ২৮ অক্টোবর থেকে অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও। ইসরায়েরি বাহিনীর নৃশংস বোমা হামলা উত্তর গাজা ছাড়িয়ে দক্ষিণ গাজার দিকে সম্প্রসারিত হয়েছে। এসব সহিংসতার কারণে কোনও পর্যটক বা তীর্থযাত্রী এই এলাকায় আসছেন না বলে জানিয়েছে বেথেলহেমের ব্যবসায়ীরা।
আলেকজান্ডার হোটেলের মালিক জোয়ি কানাভাতি রয়টার্সকে বলেন, আমরা চার প্রজন্ম ধরে বেথেলহেমে বসবাস করছি। আমাদের জীবনধারনের প্রধান উৎস এই হোটেল। কিন্তু আজ আমাদের হোটেলে একজনও অথিতি নেই। এটি আমার জীবদ্দশায় দেখা সবচেয়ে খারাপ বড়দিন। বেথেলহেমে বড়দিনের উৎসব বাতিল করা হয়েছে। কোনও ক্রিসমাস ট্রি নেই, কোনও আনন্দ নেই! এমন বড়দিন জীবনে দেখিনি।
ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত বেথেলহেম। এখানে প্রতি বছর বড়দিনে চার্চ অফ দ্য নেটিভিটি দেখতে আসে হাজার হাজার পর্যটক। সারা বিশ্বের খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, যিশু এখানেই জন্মেছিলেন।
জোয়ি কানাভাতি বলেন, ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর আগে আমাদের হোটেলটি বড়দিনের উৎসব উপলক্ষে পুরোপুরি বুকড হয়ে গিয়েছিল। এমনকি আগামী বছরের বড়দিনের জন্যও অনেকে হোটেল বুকিং দিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পরপরই গ্রাহকেরা তাদের বুকিং বাতিল করতে শুরু করেন। ৭ অক্টোবরের পর আমরা যত ইমেইল পেয়েছি, সবই ‘বুকিং ক্যাংসেলিং’ মেইল।
হোটেলের খালি ডাইনিং রুম দেখিয়ে তিনি বলেন, এখানে প্রতিরাতে কমপক্ষে ১২০জন মানুষ খাবার খেত। এখন পুরোটাই খালি। কোনও ক্রিসমাসের উৎসব নেই, ক্রিসমাস ডিনার নেই, ক্রিসমাস বুফে নেই।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল–আরব যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর দখল করে নেয় ইসরায়েল। তারপর থেকে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন করতে শুরু করে ইসরায়েল। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা দাবি করে, এই ভূখণ্ড তাদের। ইসরায়েল এই ভূখণ্ড অবৈধভাবে এবং জোর করে দখল করছে।
প্রতি বছর বড়দিনের উৎসবের কেন্দ্রে থাকে বেথেলহেমের চার্চ অফ দ্য নেটিভিটির সামনের একটি বড় পাকা জায়গা, যেটি ম্যাঞ্জার স্কোয়ার নামে পরিচিত। আজকের বড়দিনে সেটি শুনসান, নীরব এবং প্রায় ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আশপাশের রাস্তার দোকানগুলো প্রায় সবই বন্ধ।
রনি তাবাশ নামের একজন স্যুভেনির দোকানদার বলেন, প্রায় দুই ধরে এখানে কোনও তীর্থযাত্রী নেই। কোনও পর্যটক নেই। তারপরও প্রতিদিনের অভ্যাসবশত দোকান খুলে বসে থাকি। আশায় থাকি, আবার সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হবে।
আলায়া সালামেহ নামের একজন রেস্টুরেন্ট মালিক বলেন, তাঁর ব্যবসা নেই বললেই চলে। কোনও বিদেশি নেই, শুধু অল্প কয়েকজন স্থানীয় ফিলিস্তিনি তাঁর রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নেন। তারপরও তিনি রেস্টুরেন্ট খোলা রেখেছেন। কারণ রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দিলে তার কর্মীরা বেকার হয়ে পড়বে।
আলায়া সালামেহ আরও বলেন, এতদিন যে কর্মীরা আমার ব্যবসা চালিয়ে নিয়েছেন, তাদেরকে তো এই দুঃসময়ে তাড়িয়ে দিতে পারি না। কিন্তু প্রতি মাসে কোথা থেকে তাদের বেতন দেব, সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। আপনি জানেন, বেথেলহেম সেই শহর যেখানে শান্তির বার্তাবাহকের জন্ম হয়েছিল। এই শহরটির তাই উচিত ছিল সারা বিশ্বের কাছে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় ইরেজ সীমান্তে অতর্কিত হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। ইসরায়েল দাবি করেছে, ওই অভিযানে প্রায় এক হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হয়। এ ছাড়া প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি করা হয়। তারপর ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। পরে ২৮ অক্টোবর থেকে অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও।
ইসরায়েলি বাহিনীর দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা অভিযানে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা, নিহত হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। এই নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী, শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরী এবং বয়স্ক লোকজন। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৫২ হাজার ৫৮৬ জন এবং এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ৬ হাজার ৭০০ জন। এ ছাড়া হাজার হাজার পরিবার বাড়িঘর-সহায় সম্বল হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন স্কুল, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।