আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিন বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এখনও দেশে বিদেশে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আগামী নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে উন্নয়ন ও দেশ বিরোধী শক্তিকে সমুচিত জবাব দেবার কথা বলেন তিনি। কেউ যেন অর্থ দিয়ে ভোটারদের কিনতে না পারে সে বিষয়ে জনগণকে সতর্ক থাকার কথা বলেন শেখ হাসিনা।
ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে আজ মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) বিকেলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। দুপুর ১টা ৮ মিনিটে কোরআন তেলাওয়াত, গীতা ও বাইবেল পাঠের মাধ্যমে এই সমাবেশ শুরু হয়।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, “২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। তরুণ সমাজ নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলবে। শিক্ষা কারিকুলামও আমরা সেইভাবে সাজিয়েছি। ‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি’ এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই। এই বাংলার জনগণের মাঝে আমি আমার হারানো বাবার স্নেহ খুঁজে পাই, ভালোবাসা খুঁজে পাই।”
শেখ হাসিনা বলেন, শূন্য হাতে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে জাতির পিতা যাত্রা শুরু করেন। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯২ ডলার। ওই অবস্থা থেকে মাত্র ৩ বছর সাত মাসের ব্যবধানে এই বিধ্বস্ত দেশে তিনি রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, রেল গড়ে তোলেন। দেশ যখন উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয় তখন নেমে আসে এক অমানিশার অন্ধকার। ৭৫ এর ১৫ আগস্টে সেই দিন জাতির পিতা শেখ মুজিবসহ আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করে ওই খুনিরা। যারা আমাদের স্বাধীনতা চায়নি। সাথে ছিল আমাদের কিছু বেঈমান মোনাফেক। সেদিন আমি ও আমার বোন দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই। তখন রিফুইজি হিসেবে আমাদেরকে থাকতে হয়েছিল।
তিনি বলেন, ৬ বছর পর ৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ পাই। এই সমগ্র বাংলাদেশ আমি ঘুরে বেড়াই একটাই লক্ষ্য নিয়ে যে, এই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করব। জাতির পিতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রেখে এই দেশের উন্নয়ন করব। আপনারা আমাকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন বলেই আমি সরকার গঠন করতে পেরেছি। ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসি। বিদ্যুৎ নাই, পানি নাই, দেশের মানুষের শিক্ষা নাই , চিকিৎসা নাই। প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ থেকে আমরা ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করি। স্বাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে ৬৫ দশমিক ৫ ভাগে উন্নীত করি। মানুষ স্বস্তিতে বসবাস শুরু করে। আমরা এগিয়ে যাই। কিন্তু সেই সুখও বেশি দিন টেকে নাই। আমরা ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতায় আসা মানে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, লুটপাট আর দুঃশাসন। এই দুঃশাসনে দেশ অচল হয়ে যায়। আসে ইমারজেন্সি। যদিও আমি বিরোধী দলে ছিলাম আমাকে আগে গ্রেপ্তার করে। আমি জাতির পিতার কন্যা কারও কাছে মাথা নত করি না, মাথা নত করব না। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছিল গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে। আমি গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি বলেই ষড়যন্ত্র করে আমাকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি।
তিনি বলেন,২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৩৩টা সিটে জয়লাভ করে। আর এই বিএনপি বড় বড় কথা বলে, লম্পঝম্প করে তারা পেয়েছিল মাত্র ৩০টা সিট। যে কারণে তারা ২০১৪ তে নির্বাচন করেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করে নিজেদের মধ্যে গোলমাল করে সরে যায়। আওয়ামী লীগ জনগণের সমর্থন নিয়ে ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০২৩ পর্যন্ত ১৫ বছর ক্ষমতায় আছে। আমাদের দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ২০০৮ এর ঘোষণা অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। প্রত্যেকটা মানুষের কাছে মোবাইল ফোন পৌঁছে দিয়েছি হাতে হাতে। ওয়াইফাই কানেকশন দিয়ে দিয়েছি, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে আমরা ব্রডব্যান্ড সংযোগ দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট আমরা উৎক্ষেপণ করেছি। আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রত্যেক স্কুলে আমরা কম্পিউটার ল্যাব করে দিচ্ছি, আমাদের যুবকদের জন্য কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার তৈরি করে সেখানে তাদেরকে আমরা ট্রেনিং দিচ্ছি, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং, শেখো, কাজ করো এবং উপার্জন করো সেই লক্ষ্য নিয়ে। ছয় লাখ ৮৬ জন ফ্রিল্যান্সার দেশে বসে বিদেশের মুদ্রা উপার্জন করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটু জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে। শাক-সবজি মাছ মাংস উৎপাদন করতে হবে। আমার গণভবন ছোট-খাটো খামার বাড়ি। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এসে দেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে দেশ গড়তে নেমে পড়ি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি জাতির পিতার কন্যা। কারও কাছে মাথা নত করি না, মাথা নত করব না। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছিল গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে। আমি গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি বলে ষড়যন্ত্র করে আমাকে আসতে দেয়নি। খালেদা জিয়া মেট্রিক পরীক্ষায় শুধু অংক আর উর্দুতে পাস করেছেন, তাই ফেয়ারে পাকিস্তান বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি, অনলাইনে মিটিং করেছি। দেশের জন্য কাজ করেছি। যাদের জায়গা জমি নেই তাদেরকে আমি ঘর করে দিচ্ছি এমনকি ঢাকায় বস্তিবাসীদেরকে ফ্ল্যাট করে দিচ্ছি। প্রতিবন্ধী,বিধবা, বাবা-স্বামীর সংসারে ঠাই হয়নি এমন নারীদের ভাতা করে দিচ্ছি। কোভিড-১৯ যখন শুরু হয় তখন আমাদের সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। তখন দরিদ্র শ্রেণি যেন অভুক্ত না থাকে সেজন্য আমরা প্রায় ৫ কোটি পারিবারিক কার্ডের মাধ্যমে আমরা তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। আমরা বিনা পয়সায় জানুয়ারির ১ তারিখে সমস্ত শিশুর হাতে বই দিয়েছি। প্রত্যেকটা স্কুলেই আমরা পর্যায়ক্রমিকভাবে কম্পিউটার ল্যাব আমরা করে দেব। সেই সাথে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ১০৯টি হাইটেক পার্ক আমরা করে দিচ্ছি। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে, আমাদের ছেলে-মেয়েরা কাজ পাচ্ছে।
আ.লীগ সরকার অসহায় বৃদ্ধের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৯ লাখ ১০ হাজার প্রতিবন্ধিকে ভাতা দেয়া হয়। সারাদেশে বিনামূল্যে বই দেয়ার ব্যবস্থা করছে সরকার। মায়েদেরকে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান করি আমরা। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করেছি। ২০২৩ সালে সাড়ে ১২ হাজার টাকায় উন্নীত করেছি।
জনসভায় তিনি আরো বলেন, এক মাত্র নৌকা মার্কায় ভোট দিলেই আমি সরকারে আসতে পারবো। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো। দেশের উন্নয়ন হবে। আমরা ব্যাপাক ভাবে ব্যবসা করার সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে দিয়েছি। অনেককে বলতে গেলে নর্দামা থেকে টেনে তুলেছি। তাদের পয়সা বানানো ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছি। মিডিয়া চালানোর সুযোগ দিয়েছি। এখন তারা টাকা ছড়ায়। তারা মনে করে টাকা দিয়েই সব কেনা যাবে। আমি এই টাকা ওয়ালাদের টাকা ছড়ানো দেখছি। টাকা ছিটাক, এতে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা যাবে। টাকা দিয়ে অমানুষ কেনা যায় না। টাকা দিয়ে ফরিদপুরের মানুষকে কেনা যায়নি যাবে না। নৌকায় ভোট দিলেই দেশের উন্নয়ন হবে। নৌকাই আপনাদের সমাধান দিবে। এ মাটি বঙ্গবন্ধুর মাটি।
নির্বাচনী জনসভায় উপস্থিত ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ মনোনীত ৪ প্রার্থী, রাজবাড়ীর ২ জন এবং মাগুরায় নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানকে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
বক্তব্যে তার শাসনামলের নানা উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন। বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে উন্নয়ন হয়। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারিরা এখনো অপতৎপরতায় লিপ্ত। দেশের উন্নয়নের জন্য নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার আহবান জানান তিনি।
ফরিদপুর বঙ্গবন্ধুর ঘাটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই জেলার মানুষ নৌকার বাইরে যেতে পারে না। সরকার গঠন করে দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার কথাও বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
শহরের প্রাণকেন্দ্র সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভায় বেলা তিনটায় যোগ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার আগেই ফরিদপুর শহর ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে সমাবেশস্থল।
পদ্মা পাড়ের জেলা ফরিদপুরে ছয় বছর পর আওয়ামী লীগের জনসভা। শহরের প্রাণকেন্দ্র সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলীয় প্রধানের আগমন উপলক্ষে উৎসবের শহরে পরিণত হয় গোটা ফরিদপুর।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে সড়কপথে ফরিদপুরে আসেন। দুপুরে ফরিদপুর পৌঁছে তিনি সার্কিট হাউসে দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন। বিকেল ৩টার দিকে তিনি সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে সভাস্থলে আসেন। জনসভা শেষ করে সড়কপথে তিনি ঢাকায় রওনা দেন।