কেন বাদ পড়লেন সদ্য বিদায়ী মন্ত্রিসভার ৩০ মন্ত্রী!
- আপডেট সময় : ০৭:১৮:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৪
- / ৪২৩ বার পড়া হয়েছে
নানা কারণে সদ্য বিদায়ী মন্ত্রিসভায় থাকা ৩০ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীকে বাদ দিয়েই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে নতুন-পুরোনো সহকর্মী নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন সরকারের যাত্রা।
কিন্তু সব ছাপিয়ে বিদায়ী মন্ত্রিসভার কারা কেন এবার বাদ পড়েছেন, তা নিয়েই চলছে জোর আলোচনা। বাদের তালিকায় রয়েছেন ১৫ মন্ত্রী, ১৩ প্রতিমন্ত্রী ও দু’জন উপমন্ত্রী। সমকালের অনুসন্ধানে এসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর বাদ পড়ার নানা কারণ উঠে এসেছে।
বাদ পড়া মন্ত্রীরা হলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ।
এ ছাড়াও বাদ পড়েছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, বন ও জলবায়ু বিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
জানা গেছে, বিভিন্ন সময় বেফাঁস মন্তব্য ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ায়ও নতুন মন্ত্রিসভায় জায়গা হয়নি কয়েকজনের। তবে সব রকমের যোগ্যতা সত্ত্বেও বয়স ও শারীরিক অসুস্থতা এবং আঞ্চলিক ও জেলা কোটার কারণে ছিটকে পড়তে হয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠায় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন কয়েকজন। অদক্ষতা ও অযোগ্যতার পাশাপাশি দাপ্তরিক কাজে অবহেলা, মন্ত্রণালয়ে অনুপস্থিতি, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনমনের অভিযোগও ছিল কারও কারও বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে স্বজনপ্রীতি ও নেতাকর্মীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির কারণেও দু-একজনের কপাল পুড়েছে।
এ ছাড়া নতুনদের জায়গা করে দিতে একাধিক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
সদ্য বিদায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে তিনজন এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। তারা হলেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। নিজ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি-অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়স্বজনকে প্রশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে এলাকায় জনপ্রিয়তা হারানোর কারণে মনোনয়ন পাননি তারা।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও বিদায়ী মন্ত্রিসভার আরও তিনজন প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনে জয় পাননি। তারা হচ্ছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তাদের বিরুদ্ধেও দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দলে জড়িয়ে নেতাকর্মীর আস্থা হারানোর অভিযোগ রয়েছে। ফলে এই ছয় প্রতিমন্ত্রীর ছিটকে পড়াটাই ছিল প্রত্যাশিত।
সংবিধান অনুসারে মন্ত্রিসভা গঠনের পুরোপুরি এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি কাকে এই পদে অন্তর্ভুক্ত করবেন এবং কাকে বাদ দেবেন সেটি তার এখতিয়ার। তবে বেশ কিছু মন্ত্রীর বাদ পড়ার কারণ নিয়ে দলের ভেতরে নানা আলোচনা ও অনুমান করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, এবারের মন্ত্রিসভার থেকে যারা বাদ পড়েছেন তারা যে আবার ফিরে আসবেন না এমন কোনো কথা নেই। তারা হয়তো কিছুদিন পরেও ফিরে আসতে পারেন। সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
দীর্ঘদিন মন্ত্রিসভায় থাকা ব্যক্তিদের এবার কম বিবেচনা করা হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন। এ ছাড়া আছে আঞ্চলিক হিসেবে-নিকেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যাতে মন্ত্রিসভার প্রতিনিধিত্ব থাকে সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলেও মনে করেন ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা।
এ ছাড়া মন্ত্রিসভা গঠনে আরেকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটা হচ্ছে, মন্ত্রিসভায় কেউ কেউ স্থান পেয়েছেন যারা প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ভাজন হিসেবে পরিচিত।
এবারের মন্ত্রিসভায় পূর্নাঙ্গ মন্ত্রী হিসেবে যারা নতুন এসেছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ডা. সামন্ত লাল সেন। তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। অনেকে মনে করেন তিনি শেখ হাসিনার আস্থা ভাজন। মন্ত্রী হবার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি কাজ করেছে কী না এমন প্রশ্নে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আমি ঠিক বলতে পারবো না। আমি হয়তো সিনসিয়ারলি কাজ করেছি সারা জীবন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) হয়তো দেখেছেন।
সদ্য বিদায়ী সমাজকল্যাণমন্ত্রী নূরুজ্জামান আহমেদ লালমনিরহাট-২ আসনে এবারের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতলেও নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচনের আগে এক মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশ করে টিআইবি। এর এক দিন পরই একটি দৈনিক থেকে জানা যায়, তিনি ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এ ছাড়া ২৫ অক্টোবর ঢাকার গুলশানে বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক সৈয়দ আলতাফ হোসাইনের আমন্ত্রণে নৈশভোজে অংশ নেন সাইফুজ্জামান। সেখানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস উপস্থিত ছিলেন। এ দুই কারণে এবার সাইফুজ্জামান মন্ত্রিত্ব পাননি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তিনি দাবি করেছিলেন, আলতাফ হোসাইনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এ কারণে তিনি তাঁর আমন্ত্রণে নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন।
অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও প্রভাব খাটিয়ে নিজ এলাকায় রাজনৈতিক আত্মীয়করণের কারণে নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন সদ্য বিদায়ী রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। নিজ এলাকা পঞ্চগড়ে প্রভাব খাটিয়ে রাজনৈতিক আত্মীয়করণ করেছেন। রেলে ঠিকাদারি, নিয়োগ-বাণিজ্যে তাঁর পরিবারের লোকদেরই টেনে এনেছেন।
করোনাকালে নানা কারণে সমালোচিত হয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। করোনার টিকা নিয়ে সীমাহীন অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। মানিকগঞ্জে সরকারি ওষুধ কারখানার জন্য যে এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা হবে, সেই জায়গাগুলো নিজে, ছেলেমেয়ে ও ভাইয়ের নামে কেনার অভিযোগে বিতর্কিত হন তিনি। এসব কারণে নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
বিস্তর অভিযোগ ছিল বিদায়ী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে ডুবিয়েছেন তাঁর ছেলে, ভাই, ভাগনেসহ স্বজন। পাহাড়ের জায়গা দখল করে বাংলো নির্মাণ, বনের গাছ সাবাড় করে অবৈধ করাতকল, ইউপি নির্বাচনে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন, মন্ত্রণালয়ে বদলি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রীর ছেলে ও স্বজনের বিরুদ্ধে। এর বাইরে শাহাব উদ্দিনের নিজ মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে তাঁর তেমন ধারণা ছিল না বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত পাঁচ বছরে জলবায়ু সম্মেলনসহ বিশ্ব ফোরামে বাংলাদেশ বড় ভূমিকা রাখতে পারেনি। এসব কারণে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
গত পাঁচ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি, উগ্রপন্থিদের উত্থান ঘটলেও এগুলো নিয়ন্ত্রণে সদ্য বিদায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিংয়ের ব্যর্থতা চরমে পৌঁছেছিল। তাঁর অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে পাহাড়জুড়ে নৈরাজ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে ব্যাপকভাবে।
পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়নকে পাশ কাটিয়ে বিদায়ী এই মন্ত্রী নিজেই পাহাড়ে ব্যবসার মালিক হয়েছেন; অবৈধভাবে পাহাড় দখলকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এসব কারণে এবারের নতুন মন্ত্রিসভা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়েছে।
সদ্য বিদায়ী কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক শুধু মন্ত্রীই ছিলেন না; দলের ভেতরেও গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। অনেকে মনে করেন, ‘বিএনপিকে নানা প্রস্তাব দিয়েও নির্বাচনে আনা যায়নি, এমনকি নির্বাচনে এলে বিএনপি নেতাদের জেল থেকে মুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়’– এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করে আব্দুর রাজ্জাক দেশ-বিদেশে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেন। মূলত এ কারণেই তিনি মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি বৃদ্ধিকে তাঁর বাদ পড়ার কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকেই।
বেফাঁস মন্তব্য করে ফেঁসেছেন সদ্য বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও। নিত্যপণ্যের বেসামাল বাজারদর এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠার পরও এসব নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাসহ বেফাঁস কথা বলে সমালোচিত হন তিনি। দ্রব্যমূল্য অসহনীয় মাত্রায় বাড়লেও গত বছরের ৮ নভেম্বর তিনি বলেন, ‘আমি খুব ভালো করেই জানি, এলাকার মানুষের সমস্যা নেই। আমার এলাকার নারীরা দিনে তিনবার লিপস্টিক লাগাচ্ছেন, চারবার স্যান্ডেল বদলাচ্ছেন।’ একই সময় টিপু মুনশি হঠাৎ মন্তব্য করে বসেন, ‘আমরা সিন্ডিকেটের সঙ্গে পারি না।’ টিপু মুনশির এসব বেফাঁস কথায় রংপুরসহ সারাদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’সহ বেফাঁস মন্তব্যকেই তাঁর বাদ পড়ার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
বিভিন্ন সময় বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য নিয়েও নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে ভারত সফর শেষে এসে দেশটিকে ‘আওয়ামী লীগকে আরেকবার ক্ষমতায় রাখা’-সংক্রান্ত বিতর্কিত মন্তব্য দেশ-বিদেশে সরকারকে ইমেজ সংকটে ঠেলে দেয়। এটি তাঁর নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য আব্দুল মোমেনের স্ত্রী সেলিনা মোমেনের বাড়াবাড়িকেও তাঁর বাদ পড়ার কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। মোমেন ফাউন্ডেশনের নামে জায়গা দখল, স্ত্রী বদলি ও তদবির বাণিজ্যের কারণে বিতর্কে জড়ান মোমেন। পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটির অংশের অবস্থান ছিল সব সময়।
এবারের মন্ত্রিসভায় অসুস্থ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ঠাঁই না পাওয়ার গুঞ্জন ছিল সর্বত্র। ৭৬ বছর বয়সী মুস্তফা কামাল কুমিল্লা-১০ আসনের পাঁচবারের এমপি। এর আগে পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে তাঁর মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে সদ্য সাবেক মন্ত্রীর বেশ কয়েকজন অনুসারী বলেন, অসুস্থতার কারণে গত পাঁচ বছরে তিনি মাত্র পাঁচ-ছয়বার এলাকায় এসেছেন। এ ছাড়া একাধিক বাজেট অনুষ্ঠানে বাজেট উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি।
বিদায় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো অভিযোগ নেই। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত বয়সের কারণে তিনি বাদ পড়েছেন। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারও বয়স ও অসুস্থতাজনিত কারণে বাদ পড়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সদ্য বিদায়ী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহারের বাদ পড়ার কারণ হিসেবে বয়স এবং দপ্তর সামলানোর সক্ষমতা ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য দীর্ঘদিন উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও সুন্দরবন এবং উপকূলকেন্দ্রিক তেমন কোনো উন্নয়ন তিনি করতে পারেননি। জলবায়ু ট্রাস্টের ফান্ডও সবচেয়ে কম পেয়েছে খুলনা অঞ্চল। বনকেন্দ্রিক অপরাধে তাদের নিকটজনের সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সজ্জন এবং পরিচ্ছন্ন ইমেজের মানুষ। তাঁর বাদ পড়ার পেছনে অঞ্চলভিত্তিক হিসাবনিকাশকে দায়ী মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া ‘কচুরিপানা খাওয়া’, নিকলীর সড়কে অর্থ অপচয়সহ নানা মন্তব্য করে তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়েন মান্নান। তাঁর মন্ত্রিত্ব হারানোর পেছনে এগুলোও কারণ হতে পারে। একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, মানুষ মনে করে হয়তো পারে নাই, সে জন্য বাদ পড়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা ও রকম না। আমার ধারণা ছিল, আমি হয়তো থাকব না। পরপর দু’বার মন্ত্রিসভায় থাকার পর তৃতীয়বার কাউকে মন্ত্রী করা হয় না।
সদ্য বিদায়ী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো দুর্নীতি বা অস্বচ্ছতার অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে। তবে প্লাস্টিকের ব্যবসায়ী হওয়ায় পাটশিল্পে উন্নয়নে তাঁর আন্তরিকতার অভাব ছিল বলে পাট খাতের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ায় মন্তব্য করেছেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বেশ কিছু বড় প্রকল্প গ্রহণ এবং করোনাকালে খামারিদের পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা, রমজানে সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রি ও দেশব্যাপী প্রাণিসম্পদ মেলা করে আলোচনায় এসেছিলেন। তবে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁকে তেমন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তাঁর দপ্তরগুলোতে দরপত্রে অনিয়ম, নিয়োগ দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের আধিপত্য লেগেই ছিল।
টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রিত্ব পাওয়া ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার নতুন মন্ত্রিসভায় ডাক পাননি। মন্ত্রণালয়ের একাধিক প্রকল্প এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থার প্রধান নিয়োগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দু’জন সচিবের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার কারণেই মূলত তিনি মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন বলে চাউর রয়েছে। একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। এখানে আমার মন্তব্য করার কিছু নেই। তিনি কাউকে যোগ্য মনে করতে পারেন, আবার কাউকে অযোগ্য মনে করতে পারেন। আমি একেবারে মহা যোগ্য বা ব্যর্থ– এসব কিছুই নেই।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম টানা ১০ বছর ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এবার তিনি কেন মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি, তা নিয়ে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। তবে নিজ এলাকায় শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহীর মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের বিরোধিতার বিষয়টিও কেউ কেউ বলছেন।
শাহরিয়ার আলম বলেন, মন্ত্রিসভায় আমাকে কেন রাখা হয়নি, তা আমার জানা নেই। আমার চেয়ে অনেক যোগ্য মানুষও আছেন। আমি টানা ১০ বছর মন্ত্রী থেকেছি। রাজনীতিতে পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব থাকে। আমার পাওয়ার পাল্লা অনেক বেশি ভারী। সবার ভাগ্য হয় না বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কেবিনেটে টানা ১০ বছর কাজ করার। আমি সে সুযোগ পেয়েছি। আমি কৃতজ্ঞ।
বিদায়ী যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল গাজীপুর-২ আসন থেকে টানা চারবার এমপি হয়েছেন। তবে এবার জেলা কোটা ও আঞ্চলিকতার কারণে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে গাজীপুরের স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর আত্মীয়ের অনিয়মের খবরেও বিব্রত ছিলেন তিনি। গাজীপুরের পাঁচটি সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত তিনজন আছেন নতুন মন্ত্রিসভায়।
নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি বিদায়ী গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। কারণ হিসেবে তাঁর দক্ষতার অভাবকেই দায়ী করা হচ্ছে। দায়িত্ব পালনের চার বছরে এ মন্ত্রণালয় নতুন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি। এ সময়ে গণপূর্ত বিভাগে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনাও আলোচনায় আসে। এ ছাড়া একজন সচিবের সঙ্গে শরীফ আহমেদের বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। এতে মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব প্রতীয়মান হয়। এ ছাড়া নিজ এলাকা ময়মনসিংহে শরীফের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নগরবাসী অতিষ্ঠ ছিল। এসব কারণে শরীফ মন্ত্রিত্ব পাননি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
একইভাবে আঞ্চলিক ও জেলা কোটার কারণে বিদায়ী পানিসম্পদ উপমন্ত্রী ও শরীয়তপুর-২ আসনের টানা দু’বারের এমপি এ কে এম এনামুল হক শামীমের নতুন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই মেলেনি বলে মনে করা হচ্ছে। বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে এবার তিনজনকে পূর্ণ মন্ত্রী করা হয়েছে। আর অঞ্চল সমন্বয় করতে গিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে শামীমকে।