শীতের ভরা মৌসুমেও সবজির বাজার যাচ্ছে চড়া। বাজারে এমন কোনো সবজি নেই যার দাম বাড়তি নয়। ভরা মৌসুমে সবজির পাশাপাশি সব ধরনের মাছ, মাংস, মুরগির দামও অনেক বেশি। এছাড়া, সরকার গরুর মাংসের দাম ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করলেও কে শোনে কার কথা! ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে বর্তমানে ৭৫০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি করছেন দোকানিরা। এমনকি মসলাজাত পণ্যের দামে দীর্ঘদিন ধরেই হাঁসফাঁস অবস্থা সাধারণ মানুষের। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্যের দাম কিছুটা ওঠানামা করলেও বাজার ছুটছে ঊর্ধ্বমুখী। তবে উৎপাদন বাড়ায় নতুন পেঁয়াজ ও আলুর দাম কমেছে।
পর্যাপ্ত সরবরাহের পরও চড়া চালের বাজার। নির্বাচনের পর হঠাৎ করেই দাম বাড়লেও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের দামের এমন অবস্থা। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী স্বচ্ছ বাজার ব্যবস্থাপনার ঘোষণা দেয়ার পরও আজ ছুটির দিনে তেমন কঠোর নজরদারি চোখে পড়েনি রাজধানীর বাজারগুলোতে।
বাজারে সবকিছুর এমন চড়া দামে ক্ষুব্ধ সাধারণ ক্রেতারা। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন অন্য কথা। তাদের দাবি, মৌসুমের শুরুতে আকস্মিক বৃষ্টিতে অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। এছাড়া, কয়েকদিনের অতিরিক্ত শীতে কৃষক ফসল তুলতে পারেনি, ফলে সরবরাহ কম থাকায় বেড়েছে সবজির দাম।
বাঙালির নিত্যদিনের অপরিহার্য খাদ্যপণ্যের নাম চাল। কিন্তু গেল সপ্তাহে হঠাৎ করেই বাড়তে শুরু করে এই পণ্যের দাম। সরু এবং মোটা সবধরনের চালে কেজি প্রতি বেড়েছে ৪ থেকে ৭টাকা পর্যন্ত।পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও এমন দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। তবে মূল্যবৃদ্ধির জন্য বরাবরের মতোই মিলারদের দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় উপসচিব কুলদীপ চাকমা বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পরও শুক্রবার ছুটির দিনে তেমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি রাজধানীর বাজারগুলোতে। কারওয়ানবাজারে চালের বাজারে পরিদর্শন করে কেবল দাম স্থিতিশীল রাখার পরামর্শ দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দল।
শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চড়া দামের চিত্র দেখা গেছে। এছাড়া আগের মতোই উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে মাছ, চিনি, চাল, আটা ও ডাল।
আজকের বাজারে প্রতি পিস ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায় ও প্রতি পিস বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। এছাড়া, বেগুন প্রতি কেজি ৮০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৫০ টাকা, ঢেঁড়স প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, শালগম প্রতি কেজি ৫০ টাকা ও মুলা প্রতি কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া, ঝিঙা প্রতি কেজি ৮০ টাকা, করোলা প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ক্ষিরা প্রতি কেজি ৬০ টাকা, পেঁয়াজের ফুলকি প্রতি মুঠো ২০ টাকা, টমেটো প্রতি কেজি ৬০ টাকা, সাধারণ শিম প্রতি কেজি ৬০ টাকা, আর বিচিওয়ালা লাল শিম ৮০ থেকে ১০০ টাকা, লাল আলু প্রতি কেজি ৭০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৭০ থেকে ৮০ টাকা ও ব্রুকলি প্রতি পিস ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া বাজারগুলোতে লাল শাক ১০ টাকা আঁটি, লাউ শাক ৪০, মূলা শাক ১০ থেকে ১৫, পালং শাক ১৫ ও কলমি শাক ১০ টাকা আঁটি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
চলতি সপ্তাহে এসব বাজারে নতুন পেঁয়াজ ১০ টাকা কমে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ দেশিটা (পুরাতন) ১০০ টাকা এবং ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে নতুন আলুর কেজিতে ১০ টাকা কমে ৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহেও এই আলু ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আকস্মিকভাবে কমে যায় গরুর মাংসের দাম। সেই সময় দাম কমে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি শুরু হয় ৬০০ টাকায়। পরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার পর প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তবে, বাজারে সরকারের এ নির্দেশনা মানার কোনো বালাই নেই। বর্তমানে দাম বাড়িয়ে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ টাকায় বিক্রি করছেন দোকানিরা। এছাড়া, প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকায়।
রাজধানীর তালতলা ও শেওড়াপাড়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চলতি সপ্তাহে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। যা গত সপ্তাহে ২১০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহ ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। এসব বাজারে সোনালি কক, সোনালি হাইব্রিড কক ও লেয়ার মুরগির দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমেছে। বাজারগুলোতে সোনালি কক ৩০০ টাকা, সোনালি হাইব্রিড ২৯০, দেশি মুরগি ৫০০ থেকে ৫২০ ও লেয়ার মুরগি ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি বাজারে মুরগির দাম কমায় খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। তবে মুরগির দামের কারণে বিক্রি তুলনামূলক কমেছে বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাজারগুলোতে এক ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়, হাঁসের ডিম ২২০ ও দেশি মুরগির ডিমের হালি ৮০ টাকা।
এ ব্যাপারে শেওড়াপাড়া বাজারে মুরগি বিক্রেতা সোহেল বলেন, সপ্তাহ ব্যবধানে সব ধরনের মুরগির দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমেছে। দুই মাস ধরেই মুরগির বাজারে অস্থিরতা চলছে। এতে করে আমাদের বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। তবে পাইকারি বাজারে দাম কমায় আমরাও দাম কমিয়ে বিক্রি করছি।
অপরদিকে মুদি বাজারে দেখা গেছে, সয়াবিন তেলের দাম লিটারে চার টাকা বাড়িয়ে ১৭৩ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, যা আগে ছিল ১৬৯ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৮২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮৪৫ টাকা করা হয়েছে।
প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটা ও ময়দার দাম ১০ টাকা এবং চিনির দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। বাজারে প্রতি কেজি প্যাকেটের আটার দাম এখন ৬৫ টাকা। ময়দার দাম বেড়েছে হয়েছে কেজিপ্রতি ৮০ টাকা। প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। কিন্তু মূল্যতালিকায় লেখা ছিল ১৪৮ টাকা।
অন্যদিকে, গত কিছু দিন ধরেই বাড়তি যাচ্ছে সব ধরনের মাছের দাম। আজকের বাজারে প্রতি কেজি পাঙাশ ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া, তেলাপিয়া মাছ প্রতি কেজি ২৫০ টাকা, পাবদা প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, শিং মাছ আকার ভেদে প্রতি কেজি ৪৮০ থেকে ৫৫০ টাকা, রুই মাছ প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, কাতলা প্রতি কেজি ৩২০ টাকা, চাষের কই প্রতি কেজি ৩০০ টাকা, চিংড়ি প্রতি কেজি ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা, ছোট টেংরা মাছ প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, গলদা চিংড়ি প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, বোয়াল প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ও শোল মাছ প্রতি কেজি ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে আসা লোকমান হোসেন নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘নতুন বছরে অফিসের বেতন না বাড়লেও বাসা ভাড়া ও বাজারের খরচ ঠিকই বেড়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের অবস্থা খুবই খারাপ। চাহিদামতো খাওয়া-দাওয়া আগেই ছেড়ে দিয়েছি, এখন আবার নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। নতুন সরকার যদি সচেষ্ট ও আন্তরিক থাকে, তাহলে হয়তো দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে। সরকারের কাছে এটাই আমার আকুল নিবেদন, যেন সব পণ্যের দাম কমে যায়।’