ব্রাজিলের ‘ছোট মেসি’কে নিয়ে কেন এত টানাটানি
- আপডেট সময় : ০৭:০৬:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৪০৭ বার পড়া হয়েছে
লাতিন আমেরিকার অলিতে গলিতে জন্ম নেয় অগণিত ফুটবল প্রতিভা। সেখান থেকেই উঠে এসেছেন পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদিনিও থেকে শুরু করে হালের মেসি-নেইমাররা। গলি থেকে বিশ্বফুটবলে রাজ করে তাঁরা নিজেদের এমন অবস্থানে নিয়ে গেছেন, এখন নতুন কোন প্রতিভার আবির্ভাব হলেই তাঁর নাম হয়ে যায় ‘নতুন পেলে’, ‘নতুন মারাদোনা’ কিংবা ‘নতুন মেসি’।
এইতো কিছুদিন আগে ব্রাজিলের বিস্ময়কর প্রতিভা এন্দরিককে নিয়ে টানাটানি লেগে যায় ইউরোপীয়ান ক্লাবগুলোর মধ্যে। শেষপর্যন্ত পালমেইরাস থেকে রেয়াল মাদ্রিদে নাম লিখিয়েছেন ১৭ বছর বয়সী এ তরুণ স্ট্রাইকার। সেটাও আবার চোখ কপালে তোলার মতো ৬০ মিলিয়ন ইউরোতে! সে ঘটনার বছর না পেরোতেই আবারও এক প্রতিভা নিয়ে হাজির পালমেইরাস। শুধু হাজির হয়েই বসে থাকেনি, রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে।
এস্তেভাও উইলিয়ান। বয়স মাত্র ১৬ বছর। পালমেইরাসের বয়সভিত্তিক দলে খেলেন। সেখান থেকেই নজরে আসেন ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর। অনুর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে দুর্দান্ত ফুটবল শৈলীতে জানান দিয়েছেন, দুনিয়া কাঁপাতে আসছেন তিনি। এরই মধ্যে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ‘মেসিনহো’ নামে। যার আক্ষরিক অর্থ ‘ছোট মেসি’। ইউরোপের অনেকগুলো ক্লাব এ তরুণ ফুটবলারকে চাইলেও ‘ছোট মেসি’ চাচ্ছেন স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার জার্সি গায়ে জড়াতে।
উইলিয়ানের নামের নামে ‘মেসিনহো’ নামটা বসেছে মূলত ক্রুজেইরোতে খেলার সময়ই। রাজধানী সাও পাওলোর ফ্রাঙ্কোতে ২০০৭ সালে জন্ম নেন উইলিয়ান। দশবছর বয়সে বেলো হরিজন্তের ক্রুজেইরো একাডেমিতে ভর্তি হন তিনি। সেখানে বল পায়ে দারুণ সব কারুকার্যের কারণে তাঁকে ‘ছোট মেসি’ নামে ডাকা শুরু হয়। ক্রুজেইরোতে চার বছর কাটিয়ে যোগ দেন পালমেইরাসে।
উইলিয়ানের এ দলবদল নিয়ে সে সময় ব্রাজিলের গণমাধ্যমে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যায়। মূলত ক্রজেইরো থেকে একরকম ছিনতাই করে উইলিয়ানকে দলে ভেড়ায় পালমেইরাস। তখন এ তরুণের বয়স ১৪ বছর। প্রশ্ন জাগতে পারে, কী এমন আছে উইলিয়ানের মাঝে?
ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলেই উত্তরটা সহজে মিলবে। উইলিয়ানের বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তখনই এ তরুণ প্রতিভার সঙ্গে চুক্তি করে বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড নাইকি। নেইমার-রদ্রিগোকে ছাড়িয়ে সর্বকনিষ্ঠ ব্রাজিলিয়ান হিসেবে নাইকির সঙ্গে চুক্তির রেকর্ড গড়েন উইলিয়ান। এমনকি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়িয়েছে বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটি।
ক্রুজেইরো থেকে পালমেইরাসের বয়স ভিত্তিক দলে যোগ দিয়ে আরও বেশি শানিত করেছেন নিজেকে। ২০২২ সাল থেকে একের পর এক শিরোপা জিতেছেন ক্লাবটির হয়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনুর্ধ্ব-১৭ ক্যাম্পেনাওতো পাউলিস্তা, অনুর্ধ্ব-১৫ ক্যাম্পেনাওতো পাউলিস্তা, অনুর্ধ্ব-১৭ কোপা দো ব্রাজিল, অনুর্ধ্ব-১৭ ক্যাম্পেনাওতো ব্রাজেলেইরো। সব মিলে ক্লাবটির বয়সভিত্তিক দলের হয়ে ৮টি শিরোপা জিতেছেন। একটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে সাও পাওলোর বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন তিনি।
কেবল বয়সভিত্তিক দলে না, এরইমধ্যে পালমেইরাসের মূল দলের হয়েও অভিষেক হয়েছে ‘ছোট মেসি’র। ২০২৩ সালের ব্রাজিলিয়ান সেরি আর শেষ দিনে পুরোনো ক্লাব ক্রুজেইরো বিপক্ষে ১৬ বছর ৮ মাস বয়সে পালমেইরাসের মূল দলে অভিষেক হয় ১৬ বছর ৮ মাস বয়সে। ক্লাবটির ইতিহাসে কম বয়সে অভিষেকের দিক থেকে উইলিয়ান চতুর্থ কনিষ্ঠ।
মূল দলের হয়ে এখন অবধি মাত্র ওই একটি ম্যাচ খেললেও উইলিয়ানের প্রতিভা, দক্ষতা ও মেধা নিয়ে সংশয় নেই ফুটবল বিশ্লেষকদের। এমন খুদে প্রতিভা নিজেদের করে পেতে চায় কয়েকটি ইউরোপিয়ান ক্লাব। ২০২৪ সালটা তাই উইলিয়ানের জন্য হতে পারে ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরানোর বছর। পালমেইরাসের বয়সভিত্তিক দলের প্রধান জোয়াও পাওলো সাম্পাইও মনে করেন, সাফল্য পেতেই জন্ম হয়েছে উইলিয়ানের।
ফিফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘ছোট মেসি’ সম্পর্কে সাম্পাইও বলেছেন, ‘এ ধরনের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিত্ব খুব শক্তিশালী হয়। বলতে পারেন এটা অহংবোধ। তারা মনে করে ‘আমি সেরা, আমি পারি এবং আমি করে দেখাব।’ এবং সেটা ওরা করেও দেখায়।’ উইলিয়ানকে ভিন্নগ্রহের খেলোয়াড় উল্লেখ করে সাম্পাইও আরও বলেছেন, ‘এমন অন্য গ্রহের প্রতিভাদের জন্য কাজটা করা সহজও হয়ে যায়। এটি সাধারণ মানের খেলোয়াড়দের জন্য করা খুব কঠিন। যদিও তারা সংখ্যায় বেশি থাকে।’
উইলিয়ানকে সবাই ‘ছোট মেসি’ নামে ডাকলেও সাম্পাইও মনে করেন, ১৬ বছর বয়সী এ তরুণ ফুটবলার নিজের নাম দিয়ে বিশ্বজয় করবে। সাম্পাইও বলেছেন, ‘সে এস্তেভাও হতেই চাইবে। ওকে ‘মেসিনহো’ নামে ডাকা হত। কিন্তু এটা সত্য, ওর খেলার সঙ্গে ওই আর্জেন্টাইনের (মেসির) খেলার অনেক মিল।’
মূলত উইলিয়ানের দুর্দান্ত ড্রিবলিং ক্ষমতার কারণেই তাঁকে মেসির সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়। ১৬ বছর বয়সী উইলিয়ানের যাত্রাটা সবে শুরু। তাই এখনই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি মেসির সঙ্গে তুলনা দেওয়াতে অনেকেই বিষয়টিকে বাড়াবাড়ি মনে করছেন। তবে সাম্পাওর দাবি, বলের ওপর উইলিয়ানের যে নিয়ন্ত্রণ, এসব কারণে ওকে মেসিনিও ডাকাটা মোটেও অন্যায় নয়।
এএস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাম্পাইও বলেছেন, ‘বলের ওপর ওর নিয়ন্ত্রণ অবিশ্বাস্য। এছাড়া বল পায়ে ওর গতিও দুর্দান্ত। পালমেইরাসের ফটোগ্রাফার ওর বল নিয়ে দৌড়ানোর সময় টানা ১০০টি ছবি তুলেছিল। সবগুলো ছবিতে দেখা গেছে, বল ওর বাম পায়ের সঙ্গে লেগে ছিল।’
কেবল বাম পায়েই নয়, ডান পায়েও খেলতে পারেন উইলিয়ান। তবে বাঁ পায়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে খেলেন, সেটা জানিয়ে সাম্পাইও বলেছেন, ‘ওর বাম পায়ে বিশেষ কিছু আছে।’ তবে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির এ ফুটবলার এখনই পালমেইরাসের শুরুর একাদশে খেলার জন্য শারীরিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত নন, সেটাও জানিয়েছেন সাম্পাইও, ‘(এরপরের কাজ) শারীরিকভাব উন্নতি করা। কিন্তু এটা কেবল সময় ও পরিপক্কতার ব্যাপার।’
কয়েকদিন আগে পালমেইরাস থেকে মাদ্রিদে নাম লিখিয়েছেন এন্দরিক। কিন্তু বয়স ১৮ হয়নি বলে এখনো স্প্যানিশ ক্লাবটির জার্সিতে খেলা হয়নি ১৭ বছর বয়সী ব্রাজিল তারকার। এন্দরিক ও পালমেইরাসের আরেক সতীর্ত লুইস গিলের্মোর সঙ্গে তুলনা করে উইলিয়ান প্রসঙ্গে সাম্পাইও বলেছেন, ‘কৌশলের দিকে থেকে এস্তেভাও (উইলিয়ান) ওদের চেয়েও এগিয়ে। কিন্তু ও শারীরিকভাবে এখনো পরিপক্ব নয়। দুজনের চেয়ে সে এক বছরের ছোট এবং জিনগতভাবে ওর শরীর এখনো সেভাবে বেড়ে ওঠেনি। কিন্তু সে দুর্দান্ত প্রতিভা।’
যদিও উইলিয়ানকে ‘ব্রাজিলের মেসি’ বলে ডাকা হচ্ছে, কিন্তু অনেকে তাঁর খেলার সঙ্গে আরেক আর্জেন্টাইন আনহেল ডি মারিয়ার খেলার ছাপ দেখতে পান। বল পায়ে রাখার ক্ষমতা, বাঁ পায়ে ড্রিবলিং, উইং দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়া এবং জোরালো শট নেওয়ার ক্ষমতা আছে উইলিয়ানের, যা নিয়মিত করে যাচ্ছেন ডি মারিয়া।
নিজের খেলা প্রসঙ্গে এর আগে উইলিয়ান বলেছিলেন, ‘আমি ডান প্রান্তেও খেলতে পারি। কিন্তু আমি মাঝে খেলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তাই আমি গোলের কাছাকাছি গেলে বাম-ডানের যেদিকে ফাঁকা মনে করি, সেদিকে ঢুকে যাই।’
২০২৫ সালের এপ্রিলে ১৮ তে পা দেবেন উইলিয়ান। এর আগে ব্রাজিল ছাড়তে পারবেন না তিনি। তবে এন্দরিকের মতো আগেই চুক্তি সেরে রাখতে চান। এরই মধ্যে চেলসি, আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার সিটি, পিএসজি এবং বায়ার্ন মিউনিখের মতো ক্লাব আগ্রহী দেখিয়েছে উইলিয়ানের প্রতি। তবে সবগুলো ক্লাব হতাশ হতে পারে। কারণ ১৬ বছর বয়সী এ ব্রাজিল তরুণ খেলতে চান মেসির সাবেক ক্লাব বার্সাতে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে উইলিয়ান বলেছিলেন, ‘আমার স্বপ্ন বার্সেলোনায় খেলা। এটি বিশ্বের সেরা ক্লাব। আমি বার্সাতে নেইমার, মেসি এবং (লুইস) সুয়ারেসের খেলা দেখে বেড়ে উঠেছি। আমারও তেমন (বার্সার জার্সি গায়ে খেলার) স্বপ্ন আছে।’
নিজেকে বার্সার সমর্থক দাবি করে উইলিয়ান আরও বলেছিলেন, ‘আমি বার্সার প্রায় সব ম্যাচ দেখি। আমি ক্লাবটির বড় সমর্থক। ওখানে যারা খেলে, তাদের প্রতি আমার ভালো লাগা কাজ করে। আশা করি, আমিও একদিন ওদের জায়গায় থাকব।’ ১৮ বছর পূর্ণ হতেই ক্যাম্প ন্যুতে খেলতে চান কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রাজিলিয়ান তরুণ বলেছেন, ‘অবশ্যই, এটা স্বপ্ন পূরণ হওয়ার মতো ব্যাপার হবে।’
তবে উইলিয়ান চাইলেই তো হবে না, বার্সাকেও চাইতে হবে। এখানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে উইলিয়ানের রিলিজ ক্লস। উইলিয়ানকে দলে ভেড়াতে ৩৮ থেকে ৫১ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতে হবে। কিন্তু বার্সার বর্তমান যে অর্থনৈতিক দুর্দশা, তাতে এ তরুণের স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, সেটাও এখন বড় প্রশ্ন।
ফুটবল বিষয়ক ওয়েবসাইট গোল জানাচ্ছে, রিলিজ ক্লজের কম মূল্যে উইলিয়ানকে দলে ভেড়াতে চেষ্টা চালাচ্ছে চেলসি। উইলিয়ানের বাবা এরই মধ্যে পিএসজি, সিটি ও চেলসিসহ বেশ কয়েকটি এলিট ক্লাবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাই কোন ক্লাবে যাবেন উইলিয়ান, এটা এখনই বলার সুযোগ নেই। তবে ইউরোপের বড় ক্লাবই যে ব্রাজিলিয়ান তরুণের পরের গন্তব্য হবে, সেটা না বললেও চলে।
পালমেইরাসের বয়সভিত্তিক দলের প্রধান সাম্পাইও মনে করেন, উইলিয়ান যে ক্লাবেই যাক না কেন, সেখানেই নিজের প্রতিভা মেলে ধরবে, ‘আমরা দেখি উইলিয়ান শেষ অবধি কোন ক্লাব যায়। (যেখানেই যাক) আমি নিশ্চিত, সে এমন একজন খেলোয়াড়, যে বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করবে।’
Estevao Willian vs Sao Bernardo
first career goal contribution, and what a time to get it💎@estevaowillian_ pic.twitter.com/SAb1XKxeCQ
— 𝐒𝐡𝐚𝐝𝐢𝐧𝐡𝐨™ (@szniic) February 16, 2024