চলতি বছর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শেষ হচ্ছে বহুল কাঙ্ক্ষিত থার্ড টার্মিনালের নির্মাণ কাজ। অক্টোবরেই খুলে দেয়া হবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এই টার্মিনাল। তবে বিদেশি কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি না হওয়ায়, বিমানকে দিয়েই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ শুরু করতে চায় বেবিচক।
বেবিচক জানায়, চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আগামী ৫ এপ্রিল থার্ড টার্মিনালের সব কাজ শেষ করবে। ৬ এপ্রিল বেবিচক বুঝে নেবে। এরপর থেকে নানা ট্রায়াল শেষে অপারেশন শুরু করবে এই টার্মিনাল।
বেবিচকের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অপারেশন প্রথমদিন থেকেই নতুন টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের প্রয়োজন হবে। সরকারের পক্ষ থেকে জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির কথা বলা হলেও ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। তাই শুরুতে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ দেওয়ার কথা ভাবছে বেবিচক। এমন ইঙ্গিত পেয়ে ইতোমধ্যে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিমান।
গত বছরের ৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অ্যাভিয়েশন খাতে সম্ভাবনার তৃতীয় টার্মিনালের একাংশ উদ্বোধন করেন। সে সময় শেষ হয়েছিলো পরিকল্পনার ৯০ শতাংশ কাজ। কথা ছিলো ২০২৪ এর শেষ নাগাদ যাত্রীদের জন্য খুলে দেয়া হবে এই টার্মিনাল।
ইতোমধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের সুবিধা নিতে শুরু করেছে। অবতরণের পর দু'টি হাই স্পিড এক্সিট ট্যাক্সিওয়ে ব্যবহার করে উড়োজাহাজগুলো দ্রুতই রানওয়ে থেকে বের হয়ে যেতে পারছে। এছাড়া চলতি বছর এপ্রিলে এ্যাপ্রোন ও কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার শুরু করবে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দর।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের সাথে জাপানের চুক্তি হতে জুলাই কিংবা আগস্টে চলে যাবে। এই চুক্তি হলে তারা টেকওভার করবে। কিন্তু তখন টেকওভার করে অক্টোবরে তাদেরকে দিয়ে চালানো অসম্ভব। সেজন্য আমার আগ্রহ হচ্ছে, আমরা কাজটা বুঝে নিয়ে চালু করে দেবো।’
অক্টোবরে অপারেশনে আসতে এখন পুরোদমে চলছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুশীলনের কাজ। শিগগিরই পুরাতন থেকে নতুন টার্মিনালে স্থানান্তর করা হবে অবকাঠামো ও জনবল।
বেবিচক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পুরনো টার্মিনাল থেকে নতুন টার্মিনালে যাওয়ার একটা প্রসেস আছে। এই প্রসেস আমরা চালু করে দিয়েছি। আশা করছি, চুক্তি অনুযায়ী আমরা আগামী ৬ এপ্রিল কাজ বুঝে নেবো।’
এদিকে দেশের সব বিমানবন্দরে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব চায় সংস্থাটি। এজন্য ইতোমধ্যে ১০০০ কোটি টাকার সরঞ্জাম কিনেছে, বাড়াচ্ছে জনবল। যদিও তাদের বিরুদ্ধে আছে অব্যবস্থাপনা, নিম্নমানের সেবা ও যাত্রী হয়রানির অভিযোগ।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি শফিউল আজিম দাবি করেন, বর্তমান বিমানবন্দরে সুযোগ-সুবিধার অভাবেই সেবা দিতে পারেনি বিমান। বিশ্বমানের টার্মিনালে বিশ্বমানের সেবা দিতে প্রস্তুত তারা।
তবে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করতে পর্যাপ্ত সরঞ্জামের পাশাপাশি বিমানকে জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। তা নাহলে ফের ইমেজ সংকটে পড়তে পারে দেশ।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তারা যদি সার্ভিস দিতে পারে দেবে। কিন্তু আগে যারা জিনিসপত্র আছাড় মেরে ফেলে দিয়েছে, তারা যদি একইভাবে এমনটি করে তাহলে আশা বা ভরসা করা যায় না।’ ইতোমধ্যে নতুন ফ্লাইটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো।
এদিকে ২০২৩ সালের শেষ থেকে ইতোমধ্যেই তৃতীয় টার্মিনালের সুবিধা নিতে শুরু করেছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। অবতরণের পর দুটি হাই স্পিড এক্সিট ট্যাক্সিওয়ে ব্যবহার করে উড়োজাহাজ গুলো দ্রুতই রানওয়ে থেকে বের হয়ে যেতে পারছে।
এর আগে চলতি বছরের ৭ অক্টোবর আংশিকভাবে উদ্বোধন করা হয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল (থার্ড টার্মিনাল)। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর কাজ শুরু হওয়া টার্মিনালটি ছিল সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। এটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অত্যাধুনিক এ টার্মিনালের উদ্বোধনের ফলে পৃথিবীতে ঢাকা বিমানবন্দরের গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে বেড়েছে। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা।
কী থাকছে থার্ড টার্মিনালে?
বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের স্থাপনা থেকে চোখ ফেরানো দায় বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাঁচ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের এ টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ রাখার অ্যাপ্রোন (উড়োজাহাজ পার্ক করার জায়গা) করা হয়েছে।
মডার্ন টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের আয়তন দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। এ বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকবে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ও অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ছোঁয়া। এতে থাকবে বেশ কয়েকটি স্ট্রেইট এস্কেলেটর। যারা বিমানবন্দরের দীর্ঘপথ হাঁটতে পারবেন না, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ বিশ্বের অত্যাধুনিক ও বেশি যাত্রী প্রবাহের বিমানবন্দরগুলোতে এ ধরনের এস্কেলেটর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি যাত্রীদের শান্ত ও মসৃণ যাত্রার অভিজ্ঞতা দেয়।
নতুন এ টার্মিনালে যাত্রীদের ব্যাগের জন্য সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি ও ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের মতো অত্যাধুনিক তিনটি আলাদা স্টোরেজ এরিয়া করা হয়েছে। এগুলো হলো— রেগুলার ব্যাগেজ স্টোরেজ, লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড এবং ওড সাইজ (অতিরিক্ত ওজনের) ব্যাগেজ স্টোরেজ। যাত্রীদের স্বাভাবিক ওজনের ব্যাগেজের ১৬টি রেগুলার ব্যাগেজ বেল্ট থাকবে টার্মিনালটিতে। অতিরিক্ত ওজনের (ওড সাইজ) ব্যাগেজের জন্য স্থাপন করা হয়েছে আরও চারটি পৃথক বেল্ট।
টার্মিনালের প্রতিটি ওয়াশরুমের সামনে থাকবে একটি করে দৃষ্টিনন্দন বেবি কেয়ার লাউঞ্জ। এ লাউঞ্জের ভেতর মায়েদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং বুথ, ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা এবং একটি বড় পরিসরে ফ্যামিলি বাথরুম করা হয়েছে। এ ছাড়া, বাচ্চাদের স্লিপার-দোলনাসহ একটি চিলড্রেন প্লে এরিয়াও রাখা হয়েছে এখানে। ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে হেলথ ইন্সপেকশন রুম, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট-এইড রুম, করোনাসহ নানা রোগের টেস্টিং সেন্টার ও আইসোলেশন এরিয়া।
অত্যাধুনিক এ টার্মিনাল ভবনে থাকবে ১০টি সেলফ চেক-ইন কিওস্ক (মেশিন)। এগুলোতে পাসপোর্ট ও টিকিটের তথ্য প্রবেশ করালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে বোর্ডিং পাস ও সিট নম্বর। এরপর নির্ধারিত জায়গায় যাত্রী তার লাগেজ রাখবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাগেজগুলো উড়োজাহাজের নির্ধারিত স্থানে চলে যাবে। তবে, নির্ধারিত ৩০ কেজির বেশি ওজনের ব্যাগেজ নিয়ে এখানে চেক-ইন করা যাবে না। যাত্রীদের জন্য আরও ১০০টি চেক-ইন কাউন্টার থাকবে এ টার্মিনালে।
অবসরে যাত্রীদের সময় কাটানোর জন্য নতুন এ টার্মিনালে শিগগিরই করা হচ্ছে মুভি লাউঞ্জ, এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ। এ দুই লাউঞ্জ বাদে অন্যান্য স্থাপনাগুলো ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে। তবে, পরীক্ষামূলকভাবে এখনো এগুলো চালানো হয়নি। ডিসেম্বরের মধ্যেই এগুলোর কার্যক্রম শুরু হবে।