কাঁচঘেরা রেস্টুরেন্ট যেন এক একটি মৃত্যুপুরী
- আপডেট সময় : ০৫:৫৩:২৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ মার্চ ২০২৪
- / ৪৮৩ বার পড়া হয়েছে
রাজধানীর নামিদামি এলাকাজুড়েই রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। বাইরে চাকচিক্য থাকলেও ভেতরে মৃত্যুফাঁদ। আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন না থাকলেও নিয়ম ভেঙে গাদাগাদি করে চলছে নামিদামি সব রেস্টুরেন্ট। জরাজীর্ণ ভবনে ছোট্ট সিড়িই আসা যাওয়ার একমাত্র পথ, কোনো কোনো জায়গায় সেটিও বন্ধ থাকে। কাঁচঘেরা এসব রেস্টুরেন্ট যেন এক একটি মৃত্যুপুরী। প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ঝুঁকিপূর্ণভাবে একাধিক সিলিন্ডার পাশাপাশি রেখে ডজনখানেক চুলায় দিনভর চলে রান্না।
গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভবনটিতে বিপুল গ্যাস সিলিন্ডারের মজুত ছিল, ছিল না অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা।
এ দুর্ঘটনার আবার আলোচনায় এসেছে রাজধানীর অসংখ্য অনুমোদনহীন ভবনের রেস্তোরাঁ ব্যবসা নিয়ে। আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। তবে অনুমতির বাইরে যারা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ নগর পরিকল্পনাবিদদের।
বেইলি রোডে আগুন লাগা গ্রিন কজি কটেজ লাগোয়া আরেকটি ভবন গোল্ডেন প্যালেসে বড় বড় সব নামিদামি রেস্টুরেন্ট। আবাসিক ভবনটির পঞ্চম তলা জুড়েই রয়েছে রেস্টুরেন্টসহ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, নিচ থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ওঠার সিঁড়ি একেবারেই সরু। সিড়ির পাশেই রাখা আছে নানা সামগ্রী।
গোল্ড প্যালেস ভবনটিতে ৫টি রেস্টুরেন্ট, একমাত্র সিড়িটা বন্ধ ছিল যা দুর্ঘটনার পর পরিষ্কার করা হচ্ছে। আশপাশের পড়ে থাকা স্থাপনা দেখেই বোঝা যায়, পাশের ব্লিডিং এ দুর্ঘটনার পর থেকে পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু হয়। ভবন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন যেন এ সিড়ি ব্যবহারের উপযুক্ত হয়।
কথা হয়, ভবনটির কেয়ারটেকারের সঙ্গে, প্রথমে সবকিছু ঠিকঠাক আছে বলে দাবি করলেও পরে জানালেন, তারা নিজেরাও শঙ্কিত। কেয়ারটেকার জানান, আল্লাহ যদি দুর্ঘটনা ঘটায়, রাস্তা থেকেও তো মানুষ মারা যায়, যদি দুর্ঘটনা ঘটেই দেখা যাক কী হয়।
বেইলি রোডের ফকরুদ্দিন বিরিয়ানি হাউজ। গ্রাহকদের জন্য তিনতলায় ৮০ আসনের বসার ব্যবস্থা থাকলেও সিড়ি দিয়ে একসঙ্গে ২ জন আসা–যাওয়াও কষ্টকর। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কী হবে তা সময়ই বলে দিবে কারণ, বের হওয়ার জায়গা একমাত্র সরু সিড়িটিই। ভবনটি কতটা নিরাপদ জানতে চাইলে শীঘ্রই সিড়ি ভাঙার কথা জানালেন হোটেল কর্মচারী।
ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে‘গাউছিয়া টুইন পিক’ নামের এই ভবনটির প্রায় পুরোটাতেই আছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট। ভবনটির স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ আজ শুক্রবার এক ফেসবুক পোস্টে ওই ভবন নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, নির্দিষ্ট ব্যবহারের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে জমির মালিক ও ডেভেলপারকে বারবার লিখিতভাবে সতর্ক করা হলেও কোনো ফল মেলেনি বলে দাবি তাঁর।
ভবনটি সম্পর্কে অভিযোগ করে এই স্থপতি লিখেছেন, ‘যতদূর জানি, এই ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার অবস্থা ক্রমান্বয়ে ভয়াবহভাবে অবনমিত করা হয়েছে। ফায়ার ডোর খুলে ফেলা হয়েছে, ফায়ার স্টেয়ার স্টোররুম হয়েছে, যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে…।’
ভবনটির নকশা ও অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সার্বিকভাবে ভবনটিকে অগ্নিঝুকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রুপান্তর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মুস্তাফা খালিদ পলাশ। তিনি তাঁর পোস্টে লিখেছেন, ‘অর্থগৃধনুতার কাছে আমার আহাজারি বারবারই নিস্ফল হচ্ছে। ডেভেলপারকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে তাদের নাকি ফায়ার লাইসেন্স আছে। কী করে সম্ভব সেটা? কপি চাইলে নিরুত্তর। জমির মালিককে বললে উত্তর, ভাড়া হয় না তাই আর কি করা! তাদেরকে এও জানানো হয় যে, সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবনের স্থপতি হিসেবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ করা হবে।’
রাজধানীতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। তবে, অনুমতির বাইরে যারা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ নগর পরিকল্পনাবিদদের।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব বলেন, ‘৬টি সংস্থা এসব অবৈধ রেস্টুরেন্ট ও ভবনের দায় নিতে বাধ্য, কোনোভাবেই তারা এমৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। সারা ঢাকা শহরে সবগুলো রেস্টুরেন্টেরই একই অবস্থা।’
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলালউদ্দিন বলেন, ‘শাস্তি পেতে আপত্তি নেই, তবে যারা দেখভালের দায়িত্বে তাদেরও জবাবদিহির আওতার আনা উচিত।’
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আবাসিক এলাকায় রেস্টুরেন্ট কোনোভাবেই থাকতে পারবে না। আর রেস্টুরেন্ট করতে চাইলে অবশ্যই খোলামেলা পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই।