প্রথম ম্যাচ হেরে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ আজ (বুধবার) সিরিজে সমতা ফেরাল। এর আগে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথমটিতে হারের পর বাংলাদেশের সিরিজ জিতেছে মাত্র একবারই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই জয় এসেছিল ২০১৮ সালের আগস্টে।
আগের ম্যাচে লক্ষ্য ছিল বড়, তাতে টপ অর্ডার ব্যর্থ। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও জাকের আলী অনিকের দারুণ দুই ফিফটিতে তাই শেষ পর্যন্ত লড়ে, জয়ের আশা ফিরিয়েও সেদিন আর জেতা হয়নি বাংলাদেশের। আফসোসের পাশাপাশি সেদিন উপলব্ধি ছিল, বাংলাদেশ মূলত দুটি জায়গায় হেরেছে – ডেথ ওভারের বোলিং আর টপ অর্ডারের ব্যাটিং।
সিলেটে আজ দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে বোলিংয়ে ডেথ ওভারে বাংলাদেশ একেবারে রান বিলিয়ে দেয়নি, ফলে লক্ষ্যই আজ ছিল অনেক কম – ১৬৬ রানের। এরপর প্রথম ম্যাচের দ্বিতীয় ভুলও কী দারুণভাবে শুধরে নিল বাংলাদেশ! লিটন-সৌম্যর এনে দেওয়া শুরুর পর শান্ত আর হৃদয়ের ৮৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি বাংলাদেশকে আজ ৮ উইকেট আর ১১ বল হাতে রেখেই জিতিয়ে দিল। মাহমুদউল্লাহ আর জাকের আলীর আজ তাই আর হাততালি দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে হলো না!
টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানই আজ রান পেয়েছেন। ভাগ্যের সৌজন্যে বেঁচে যাওয়া সৌম্য ২৬ রান করলেও লিটন আর হৃদয় গেছেন ৩০-এর ঘরে, শান্ত তো বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করা ছক্কায় ফিফটিই পেয়ে গেলেন!
রেকর্ড গড়ে জেতার লক্ষ্য ছিল আগের ম্যাচেও, আজ ছিল আগের রেকর্ড ছোঁয়ার লক্ষ্য। এভাবে রেকর্ড-টেকর্ড মিলিয়ে বললে খেলা না দেখে থাকা কারও কাছে মনে হতে পারে, আজও বুঝি বড় লক্ষ্যই পেয়েছে বাংলাদেশ! কিন্তু সিলেটে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টির সঙ্গে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের লক্ষ্যে কত বড় পার্থক্যই না ছিল!
ওহ, রেকর্ডটা কী? দেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতার। সেই যে ২০১৬ সালে খুলনায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রানতাড়ায় ১৬৬ রান করে জিতেছিল বাংলাদেশ, এখনো সেটিই দেশের মাটিতে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের রানতাড়ায় সবচেয়ে বেশি রান করে জেতার রেকর্ড। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগের ম্যাচে বাংলাদেশ ২০৭ রানের লক্ষ্যে মাহমুদউল্লাহ আর জাকের আলীর অসাধারণ ব্যাটিংয়ে শেষ পর্যন্ত লড়েও হেরে গিয়েছিল ৩ রানে, নতুন রেকর্ড আর গড়া হয়নি সেদিন। আজ লক্ষ্যই ছিল ১৬৬, অর্থাৎ জিততে হলে শুধু আগের রেকর্ড ছুঁতে হতো বাংলাদেশকে।
রাতে শিশিরের কারণে বোলিং কঠিন হয়ে পড়ে, তারওপর লক্ষ্যটাও আগের ম্যাচের চেয়ে কম – বাংলাদেশ কিছুটা নির্ভার ছিল ইনিংস শুরুর আগেই। ইনিংসে যত সময় গড়িয়েছে, বাংলাদেশকে আরও নির্ভার করে দিয়েছে লিটন-শান্তদের টপ অর্ডার। আগের ম্যাচে মাহমুদউল্লাহ-জাকেরদের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের পরও বাংলাদেশের হারের কারণ ছিল টপ অর্ডারের ব্যর্থতা, আজ লিটন-শান্তদের ব্যাট কথা বলল, মাহমুদউল্লাহদের আর ঘাম ঝরাতেই হলো না।
লক্ষ্য যেখানে ওভারপ্রতি ৮-এর মতো রান দাবি করে, এমন ইনিংসে বাংলাদেশের শুরুটাই হলো ঝড় দেখানো। পাওয়ার প্লে-র ৬ ওভারেই দুই ওপেনার লিটন ও সৌম্য এনে দিলেন ৬৩ রান! এর মধ্যে অবশ্য আম্পায়ারের বদান্যতাও হাত বাড়িয়েছে। চতুর্থ ওভারে সৌম্য সরকারের নিশ্চিত আউট মাঠের আম্পায়ার দিলেও তৃতীয় আম্পায়ার কী বুঝে নট আউট দিলেন, সে এক রহস্য বটে! অথচ রিপ্লেতে পরিষ্কার দেখা গেল, বল ব্যাটের কানায় লেগে উইকেটকিপারের হাতে গেছে। সৌম্যর রান তখন ছিল ১৪, বাংলাদেশের ২৮।
সে সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ বেঁচেছে, তবে ‘জয়ের পথে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের বদান্যতা’ থেকে যাওয়ার একটু অতৃপ্তি থেকে গেছে, এই যা!
তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে সংখ্যা অনেক কমে এলেও ক্রিকেট মাঠে এমন ঘটনা তো আর একেবারে বিরল নয়। সেটিকে একপাশে রাখলে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল মন রাঙিয়ে যাওয়ার মতো। দ্বিতীয় বলেই অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের বল সৌম্যর ব্যাটের কানায় লেগে চার, তিন বল পর মিডউইকেটে লিটনের চারটা হলো দেখার মতো! প্রথম ওভারেই এল ১০ রান।
পরের আট বলে আরও চারটি চার – সৌম্যর দুটি, লিটনের দুটি। চতুর্থ ওভারে আউট থেকে বেঁচে গিয়েই দারুণ গ্লান্সে চার সৌম্যর। প্রথম পাঁচ ওভারেই ৯টি চার দেখে ফেলা বাংলাদেশ ইনিংস ষষ্ঠ ওভারে ইনিংসের প্রথম ছক্কাও দেখে ফেলল, স্কয়ার লেগে দারুণ পুল শটে। মাদুশঙ্কার ওই ওভারে পরের বলেই আবার পয়েন্টে যেভাবে চার মারলেন লিটন, দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মনে হচ্ছিল, আজ লিটন ‘মুড’-এ আছেন! শেষ বলে লিটনের প্যাডে লাগায় শ্রীলঙ্কা আবেদন করল বটে, কিন্তু এলবিডাব্লিউ তো হলোই না, উল্টো লেগ বাইয়ে আরও চার রান পেল বাংলাদেশ।
কিন্তু দারুণ পাওয়ার প্লে-র পরই ধাক্কা। একবার বেঁচে গিয়েও সৌম্য বেশিদূর এগোতে পারলেন না, সপ্তম ওভারে পাথিরানার শর্ট বলে মারতে গিয়ে দৃষ্টিকটুভাবে টাইমিংয়ে গড়বড় করে ফেললেন, মিডউইকেটে ধরা পড়ে শেষ হলো সৌম্যর ২২ বলে ২৬ রানের ভাগ্যপ্রসূত ইনিংসের।
অধিনায়ক শান্ত নেমেই অষ্টম ওভারে তিকসানাকে দারুণ লেইট কাটে চার মেরে বুঝিয়ে দিলেন, তিনিও আজ কিছু করে দেখাতে চান। করে দেখানো দরকারও ছিল। টি-টোয়েন্টিতে আগের ৮ ইনিংসে যে একবারও ২০ পেরোনো হয়নি শান্তর। তা শান্তর চার দেখে লিটন-শান্তর ব্যাটে দারুণ কিছু দেখার আশা জাগতে না জাগতেই সে আশার বেলুনও ফুটো হয়ে গেল - নবম ওভারের শেষ বলে যখন পাথিরানার আরেক শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে ‘হাফ হার্টেড’ শট খেলে ফেললেন লিটন। আসালঙ্কার হাতে ক্যাচ দিয়ে শেষ লিটনের ২৪ বলে ৫ চার ১ ছক্কায় ৩৬ রানের প্রতিশ্রুতিজাগানিয়া ইনিংস।
তিন ওভার আর ১৬ রানের মধ্যে দুই ওপেনারকে হারানো বাংলাদেশের রানের গতিতে একটু ভাটা পড়ল। তবে দুই ওপেনারের এনে দেওয়া শুরুর কারণেই ইনিংসের মাঝপথে গিয়ে দেখা গেল, বাংলাদেশের রান হয়ে গেছে ৮৬। শান্ত আর ক্রিজে তাঁর সঙ্গী তাওহীদ হৃদয়ের কাজ তখন সহজ – গতিটা ধরে রাখা, উইকেট না হারানো।
শান্ত আর হৃদয় সে কাজ ঠান্ডা মাথায় করে গেছেন – পরের চার ওভারের প্রতিটিতে অন্তত একটা বাউন্ডারি মেরেছেন তাঁরা। শ্রীলঙ্কার ফিল্ডিং-বোলিংও হাত বাড়িয়েছে। ১১তম ওভারে পাথিরানার বলে উইকেটকিপার কুশল মেন্ডিস ভজঘট পাকানোয় বাই এল চার রান। ১২তম ওভারেই ১০০ পেরিয়ে গেল বাংলাদেশ। রানের গতিটা ধরে রাখায় যা হলো, শেষ ৩০ বলে বাংলাদেশ ঢুকল আর ৩৮ রানের দূরত্বে থেকে। শান্ত বা হৃদয় দুজনের কেউই তখনো একেবারে হাত খোলেননি, খোলার দরকারও পড়েনি।
১৭তম ওভারে শানাকাকে প্রথম দুই বলেই চারের পর মিডউইকেটে দারুণ পুল শটে ছক্কা মেরে নড়েচড়ে বসলেন শান্ত, রান-বলের সমীকরণে রান তখন পিছিয়ে গেল। ১৭ ওভার শেষে বাংলাদেশের সমীকরণ দাঁড়াল – ১৮ বলে দরকার ১৪ রান। কিন্তু অতটুকুও নিলেন না শান্ত আর হৃদয়।
১৮তম ওভারের শেষ বলে তিকসানার শর্ট অব লেংথ বলে জায়গায় দাঁড়িয়ে মিডউইকেটে দারুণ ছক্কা মারলেন হৃদয়। জয় তখন আর ২ রানের দূরত্বে। নতুন ওভারে স্ট্রাইক পেলেন শান্ত, তিনি তখন ফিফটি থেকে ৩ রান দূরে। শানাকা ওভারের প্রথম বলটাই ফেললেন শান্তর প্যাডের ওপর, শান্ত আমন্ত্রণটা সাদরে গ্রহণ করলেন বলটাকে স্কয়ার লেগ গ্যালারিতে পাঠিয়ে।
সিলেটে আতশবাজি উড়ল, বাংলাদেশ ফিরল সমতায়।
বাংলাদেশের পক্ষে একটি করে উইকেট পান তাসকিন, শরিফুল, মুস্তাফিজ ও মেহেদি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা : ২০ ওভারে ১৬৫/৫ (ফার্নান্দো ০, কুশল ৩৬, কামিন্দু ৩৭, সাদিরা ৭, আসালাঙ্কা ২৮, ম্যাথুস ৩২*, শানাকা ২০*; শরিফুল ৪-১-২০-০, তাসকিন ৪-০-৩৮-১ , মেহেদি ৪-০-৩৯-১, মুস্তাফিজ ৪-০-৪২-১, রিশাদ ৩-০-২১-০, সৌম্য ১-০-৫-১)।
বাংলাদেশ : ১৮.১ ওভারে ১৭০/২ (লিটন ৩৬, সৌম্য ২৬, শান্ত ৫৩*, হৃদয় ৩২* ; ম্যাথুস ২.২-০-২২-০, মাধুশাঙ্কা ৪-০-৩৪-০, বিনুরা ৩-০-২২-০, থিকসানা ৪-০-৩৫-০, পাথিরানা ৩.৪-০-২৮-২, ১.১-০-১৯-০)
ফল : বাংলাদেশ আট উইকেটে জয়ী।