ঢাকা ০৯:৩০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

যে আটজনের চেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ করা হয়েছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ১১:৫৪:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ ২০২৪
  • / ৪৭০ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যদ্বানী। যে ভাষণ শুনে দুনিয়ার সব বাঙালি এক হয়েছিল একটি স্বাধীন ভূখন্ডের জন্য। সেই সময়ের এই ভাষণটির ভিডিও ধারণ করেছিলেন তৎকালীন চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের মুক্তিকামী বাঙালিরা।

তৎকালীন চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরা জীবনের অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদেরই ক্যামেরা ব্যবহার করে এই ভিডিও ধারণ করেন। এতে নেওয়া হয়নি সেই সময়কার কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান হয়েও সেই সময়কার সরকার বিরোধী এমন একটি ভাষণ ধারণ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না।

এই দুঃসাহসিক কাজটিই করে দেখিয়েছিলেন তৎকালীন এই অধিদপ্তরের পরিচালক মহিবুর রহমান খানের (অভিনেতা আবুল খয়ের) নির্দেশে। সেই সময়কার আট ক্যামেরাম্যান ও ক্যামেরা সহকারী এই কাজটি করেছিলেন।

প্রতিবেদনটি করতে গিয়ে প্রথমবারের মতো সংগ্রহ করা হয় তাঁদের ছবি। খোঁজ নিয়ে ও পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেই আটজনের মধ্যে পরিচালকসহ সাতজনই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাঁরা হলেন—ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন ও এম এ রউফ, ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, এস এম তৌহিদ, সৈয়দ মইনুল আহসান ও জোনায়েদ আলী এবং লাইট বয় হাবিব চোকদার ও খলিলুর রহমান।

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালকের নেতৃত্বে এই আটজনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে পুরো ভাষণটি ধারণ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মহিবুর। একটি দল পুরো ভিডিওচিত্রটি ধারণ করেন। আরেকটি দল সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি ও দর্শকদের ছবি নিয়েছেন।

সেই সময় যারা এই কর্মযজ্ঞে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এখনো বেঁচে আছেন দুজন। তাঁরা দুজনই ছিলেন ক্যামেরা সহকারী। একজন মূল ভাষণটি ধারণের দায়িত্বে ছিলেন, আরেকজন ছিলেন ভাষণের অডিও রেকর্ডের দায়িত্বে। তাঁদের দুজনের সঙ্গেই কথা এই প্রতিবেদকের।

এদের একজন আমজাদ আলী খন্দকার। সাভারের বাড়িতে বসে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি শুধু ভিডিওটি ধারণই করেননি, ২৫ মার্চের পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ভিডিওটির ফিল্ম ট্রাঙ্কে করে নিয়ে পালিয়েন যান ঢাকার বাইরে।

আমজাদ আলী বলেন, ২৫ মার্চের পর সারা দেশের সকল অফিস–আদালত দখল নিতে শুরু করে পাক–হানাদার বাহিনী। সচিবালয়েও একই অবস্থা। সেই সময়টায় চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের কর্মীদের সন্দেহ হতে শুরু করে যে, ভাষণের ভিডিওর খবর হানাদার বাহিনী পেলে যেকোনো সময় ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই তখন, তারা সেটি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন সচিবালয়ের আর্কাইভ থেকে। এই উদ্যোগটি নেন মহিবুর রহমান খান ওরফে আবুল খায়ের।’

আমজাদ আলী খানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিদপ্তরের পরিচালক তাঁকে ভিডিও রেকর্ডটি সরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দেন। তাঁকে মহিবুর রহমান খান বলেন, ভাষণটিকে একটি ট্রাঙ্কে করে যেন ঢাকার বাইরে তিনি নিয়ে যান। এই ট্রাঙ্ক কেনার জন্য টাকাও দেন তাঁকে।

নির্দেশ পেয়ে সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি মাপের একটি ট্রাঙ্ক কিনে আনেন আমজাদ। আমজাদ আলী খান বলেন, ট্রাঙ্ক আনার পর মহিবুর রহমান নিজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর করা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ও বঙ্গবন্ধুর আরও ছবি, ফিল্ম ঢুকিয়ে দেন ট্রাঙ্কের ভেতরে।

নির্দেশ পেয়ে আমজাদ আলী পরিবারের কারো সাথে দেখা না করেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন এই ট্রাঙ্কটি সচিবালয়ের আকাইর্ভ থেকে বের করার জন্য। পরিকল্পনা করেন সেটি বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে এই ট্রাঙ্ক বের করা মোটেও সহজ ছিল না তাঁর জন্য। তখন সচিবালয়ের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক পাহারা ও টহল ছিল। তখন সচিবালয়ে ঢোকার ফটক সেকেন্ড গেট দিয়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করেন তিনি।

ওই ফটকের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদও ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। তাঁর সহযোগিতাতেই ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল আমজাদ আলী ভিডিও রেকর্ডটি নিয়ে বের হয়ে যান সচিবালয় থেকে। কিন্তু বের হওয়ার সময় তাঁর সাথে আরও কয়েজন সহকর্মী বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন তাঁরা অর্ধেক এসে আর বের হননি, ভয়ের কারণে। পরে তিনি সাহস নিয়ে বের হন। এরপর তিনি সোয়ারিঘাটে হয়ে নৌকায় করে জিনজিরায় যান। পরে সেখান থেকে ট্রাঙ্কের সঙ্গে বাসের ছাদে চড়ে বসেন আমজাদ। পরে নানা চড়াই– উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছান দোহারের জয়পাড়ায় মহিবুর রহমানের বোনের বাড়িতে। এক ধানের গোলায় এই ট্রাঙ্কটি মাসখানেক রাখার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ট্রাঙ্কটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান। স্বাধীনতার পরপরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো।

এ তো গেলো ভিডিও রক্ষার মিশন। কিন্তু এই ভিডিওটি ধারণ করা এবং সেটি সংরক্ষণ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। সেই গল্পও শুনিয়েছেন তিনি। ৭ মার্চ সকালেই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিলেন তাঁদের আট জনের দল। আগেকার সময় ভিডিও ধারণ করার পর ফিল্ম ডেভেলপ করার প্রয়োজন পড়ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভাষণের ভিডিওর ফিল্ম ডেভেলপও সহজ ছিল না। কারণ চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তররের যে সকল বাঙালি কর্মী এই ভিডিও ধারণ করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের রুটিন কাজের বাইরে গিয়ে এই ভিডিও ধারণ করেন, সেই সময়কার সরকারের কোনরকম অনুমতি ছাড়াই।

কিন্তু এই ফিল্মটি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নামে ডেভেলপ করাতে গেলে যে কোনো বড় ধরনের বিপদে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই তখন সেই সময়কার কর্মীরা একটি স্বিদ্ধান্ত নিলেন—এই ফিল্মটির ট্যাগ লাইনে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করা হবে না। সেখানে লেখা হবে, আগের বছর ঘটে যাওয়া ‘ঘূর্ণিঝড়’ ও ‘নির্বাচন’–এর নাম। যে চিন্তা সেই কাজ। এভাবেই এফডিসিতে নিয়ে গিয়ে সেটিকে ডেভেলপ করা হয়েছিল।

বেঁচে থাকা আরেকজন সৈয়দ মইনুল আহসান। বাড্ডা আর্দশ নগরে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বয়সের ভারে হারিয়েছেন স্মৃতি ও শ্রবণ শক্তি। তারপরও এই প্রতিবেদক চেষ্টা করেন ইতিহাসের অংশ হওয়া এ মানুষটির সাথে কথা বলার। তাই কাগজে লিখে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করার ফলে কিছু স্মৃতিচারণ করতে পেরেছেন তিনি। সৈয়দ মইনুল আহসান বলেন, সেই দিন তিনি মঞ্চের খুব কাছেই ছিলেন। তাঁর কাজ ছিল পুরো বক্তব্যের অডিও রেকর্ড করা। পুরো সময়টা ধরে তিনি এই কাজ করেন। সৈয়দ মইনুল আহসান সে সময়ের স্মৃতিচারণের মাঝে মাঝেই ক্ষেই হারিয়ে ফেলেন। আর চিৎকার করে বলতে থাকেন সেই সময়কার বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি—‘রক্ত যখন দিয়েছি আরো দিব, তবুও নিজের দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব।’

নিউজটি শেয়ার করুন

যে আটজনের চেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ করা হয়েছিল

আপডেট সময় : ১১:৫৪:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যদ্বানী। যে ভাষণ শুনে দুনিয়ার সব বাঙালি এক হয়েছিল একটি স্বাধীন ভূখন্ডের জন্য। সেই সময়ের এই ভাষণটির ভিডিও ধারণ করেছিলেন তৎকালীন চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের মুক্তিকামী বাঙালিরা।

তৎকালীন চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরা জীবনের অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদেরই ক্যামেরা ব্যবহার করে এই ভিডিও ধারণ করেন। এতে নেওয়া হয়নি সেই সময়কার কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান হয়েও সেই সময়কার সরকার বিরোধী এমন একটি ভাষণ ধারণ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না।

এই দুঃসাহসিক কাজটিই করে দেখিয়েছিলেন তৎকালীন এই অধিদপ্তরের পরিচালক মহিবুর রহমান খানের (অভিনেতা আবুল খয়ের) নির্দেশে। সেই সময়কার আট ক্যামেরাম্যান ও ক্যামেরা সহকারী এই কাজটি করেছিলেন।

প্রতিবেদনটি করতে গিয়ে প্রথমবারের মতো সংগ্রহ করা হয় তাঁদের ছবি। খোঁজ নিয়ে ও পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেই আটজনের মধ্যে পরিচালকসহ সাতজনই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাঁরা হলেন—ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন ও এম এ রউফ, ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, এস এম তৌহিদ, সৈয়দ মইনুল আহসান ও জোনায়েদ আলী এবং লাইট বয় হাবিব চোকদার ও খলিলুর রহমান।

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালকের নেতৃত্বে এই আটজনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে পুরো ভাষণটি ধারণ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মহিবুর। একটি দল পুরো ভিডিওচিত্রটি ধারণ করেন। আরেকটি দল সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি ও দর্শকদের ছবি নিয়েছেন।

সেই সময় যারা এই কর্মযজ্ঞে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এখনো বেঁচে আছেন দুজন। তাঁরা দুজনই ছিলেন ক্যামেরা সহকারী। একজন মূল ভাষণটি ধারণের দায়িত্বে ছিলেন, আরেকজন ছিলেন ভাষণের অডিও রেকর্ডের দায়িত্বে। তাঁদের দুজনের সঙ্গেই কথা এই প্রতিবেদকের।

এদের একজন আমজাদ আলী খন্দকার। সাভারের বাড়িতে বসে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি শুধু ভিডিওটি ধারণই করেননি, ২৫ মার্চের পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ভিডিওটির ফিল্ম ট্রাঙ্কে করে নিয়ে পালিয়েন যান ঢাকার বাইরে।

আমজাদ আলী বলেন, ২৫ মার্চের পর সারা দেশের সকল অফিস–আদালত দখল নিতে শুরু করে পাক–হানাদার বাহিনী। সচিবালয়েও একই অবস্থা। সেই সময়টায় চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরের কর্মীদের সন্দেহ হতে শুরু করে যে, ভাষণের ভিডিওর খবর হানাদার বাহিনী পেলে যেকোনো সময় ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই তখন, তারা সেটি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন সচিবালয়ের আর্কাইভ থেকে। এই উদ্যোগটি নেন মহিবুর রহমান খান ওরফে আবুল খায়ের।’

আমজাদ আলী খানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিদপ্তরের পরিচালক তাঁকে ভিডিও রেকর্ডটি সরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দেন। তাঁকে মহিবুর রহমান খান বলেন, ভাষণটিকে একটি ট্রাঙ্কে করে যেন ঢাকার বাইরে তিনি নিয়ে যান। এই ট্রাঙ্ক কেনার জন্য টাকাও দেন তাঁকে।

নির্দেশ পেয়ে সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি মাপের একটি ট্রাঙ্ক কিনে আনেন আমজাদ। আমজাদ আলী খান বলেন, ট্রাঙ্ক আনার পর মহিবুর রহমান নিজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর করা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ও বঙ্গবন্ধুর আরও ছবি, ফিল্ম ঢুকিয়ে দেন ট্রাঙ্কের ভেতরে।

নির্দেশ পেয়ে আমজাদ আলী পরিবারের কারো সাথে দেখা না করেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন এই ট্রাঙ্কটি সচিবালয়ের আকাইর্ভ থেকে বের করার জন্য। পরিকল্পনা করেন সেটি বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে এই ট্রাঙ্ক বের করা মোটেও সহজ ছিল না তাঁর জন্য। তখন সচিবালয়ের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক পাহারা ও টহল ছিল। তখন সচিবালয়ে ঢোকার ফটক সেকেন্ড গেট দিয়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করেন তিনি।

ওই ফটকের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদও ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। তাঁর সহযোগিতাতেই ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল আমজাদ আলী ভিডিও রেকর্ডটি নিয়ে বের হয়ে যান সচিবালয় থেকে। কিন্তু বের হওয়ার সময় তাঁর সাথে আরও কয়েজন সহকর্মী বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন তাঁরা অর্ধেক এসে আর বের হননি, ভয়ের কারণে। পরে তিনি সাহস নিয়ে বের হন। এরপর তিনি সোয়ারিঘাটে হয়ে নৌকায় করে জিনজিরায় যান। পরে সেখান থেকে ট্রাঙ্কের সঙ্গে বাসের ছাদে চড়ে বসেন আমজাদ। পরে নানা চড়াই– উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছান দোহারের জয়পাড়ায় মহিবুর রহমানের বোনের বাড়িতে। এক ধানের গোলায় এই ট্রাঙ্কটি মাসখানেক রাখার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ট্রাঙ্কটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান। স্বাধীনতার পরপরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো।

এ তো গেলো ভিডিও রক্ষার মিশন। কিন্তু এই ভিডিওটি ধারণ করা এবং সেটি সংরক্ষণ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। সেই গল্পও শুনিয়েছেন তিনি। ৭ মার্চ সকালেই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিলেন তাঁদের আট জনের দল। আগেকার সময় ভিডিও ধারণ করার পর ফিল্ম ডেভেলপ করার প্রয়োজন পড়ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভাষণের ভিডিওর ফিল্ম ডেভেলপও সহজ ছিল না। কারণ চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তররের যে সকল বাঙালি কর্মী এই ভিডিও ধারণ করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের রুটিন কাজের বাইরে গিয়ে এই ভিডিও ধারণ করেন, সেই সময়কার সরকারের কোনরকম অনুমতি ছাড়াই।

কিন্তু এই ফিল্মটি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নামে ডেভেলপ করাতে গেলে যে কোনো বড় ধরনের বিপদে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই তখন সেই সময়কার কর্মীরা একটি স্বিদ্ধান্ত নিলেন—এই ফিল্মটির ট্যাগ লাইনে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করা হবে না। সেখানে লেখা হবে, আগের বছর ঘটে যাওয়া ‘ঘূর্ণিঝড়’ ও ‘নির্বাচন’–এর নাম। যে চিন্তা সেই কাজ। এভাবেই এফডিসিতে নিয়ে গিয়ে সেটিকে ডেভেলপ করা হয়েছিল।

বেঁচে থাকা আরেকজন সৈয়দ মইনুল আহসান। বাড্ডা আর্দশ নগরে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বয়সের ভারে হারিয়েছেন স্মৃতি ও শ্রবণ শক্তি। তারপরও এই প্রতিবেদক চেষ্টা করেন ইতিহাসের অংশ হওয়া এ মানুষটির সাথে কথা বলার। তাই কাগজে লিখে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করার ফলে কিছু স্মৃতিচারণ করতে পেরেছেন তিনি। সৈয়দ মইনুল আহসান বলেন, সেই দিন তিনি মঞ্চের খুব কাছেই ছিলেন। তাঁর কাজ ছিল পুরো বক্তব্যের অডিও রেকর্ড করা। পুরো সময়টা ধরে তিনি এই কাজ করেন। সৈয়দ মইনুল আহসান সে সময়ের স্মৃতিচারণের মাঝে মাঝেই ক্ষেই হারিয়ে ফেলেন। আর চিৎকার করে বলতে থাকেন সেই সময়কার বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি—‘রক্ত যখন দিয়েছি আরো দিব, তবুও নিজের দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব।’