ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার কৌশল ও নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার পরিধি বাড়িয়েছে জলদস্যুরা। তাই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাইরে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর। দস্যুতা ঠেকাতে জাহাজটিতে ছিল না পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। সমুদ্র পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলদস্যুতাকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা সংস্থা ও বীমা কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এছাড়া জাহাজটির ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র যাত্রায় আন্তর্জাতিক নিয়ম মানা হয়নি বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে মালিকপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ কার্গো জাহাজ চলাচল করে ভারত মহাসাগরের ভয়ংকর আফ্রিকা উপকূল ধরে। ২০০৬ সাল থেকে ভারত মহাসাগরের এডেন উপকূলে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালাতে শুরু করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তখন প্রায় ১৬৫ নটিক্যাল মাইলকে পাইরেসি জোন হিসাবে ধরা হতো।
কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে ভারত মহাসাগরের লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার জুড়ে দস্যুতার পরিধি বিস্তৃত করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জলদস্যু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পাইরেসি জোনের ৫৭০ কিলোমিটার বাইরে থাকার পরও এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটিতে আক্রমণ করে দখলে নিতে সক্ষম হয় তারা। সেফ জোনে আছে মনে করে জাহাজটি তেমন কোন নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়নি।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ছিলনা ধারালো রশি বা রেজর ওয়্যার। এ কারণে অনেকটা নির্বিঘ্নে উঠে যায় জাহাজে। এক্ষেত্রে জাহাজটির নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি ছিল বলছেন শিপিং সংশ্লিষ্টরা।
এই পথে ঝুঁকি এড়াতে নৌবাণিজ্য দপ্তরও সাম্প্রতিক সময়ে জাহাজ মালিকদের সর্তক করেছিল। তারপরও এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষের খুব একটা সর্তকতা ছিল না।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার এসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী বলেন, ‘এই জাহাজের একটি রুটিন ম্যাপ আমি দেখেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা জাহাজ দ্বারা একটি প্যাসেজ প্ল্যান করা হয়েছে। এটার কোনো অ্যামেন্ডমেন্ট হয়নি। এই প্যাসেজ প্ল্যানের মধ্যেই ওনাদেরকে ধরেছে। কিন্তু যদি কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দিত…কারণ এখানে সব ধরনের তথ্য উপাত্ত থাকত। তারা গাইড করতে পারতেন।’
মার্কেন্টাইল শিপিংয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. আবু তাহের বলেন, 'পুরো জাহাজটা রেজর ওয়্যার দিয়ে ঘেরা থাকে। জলদস্যুদের দেখলে হাইপ্রেশার হট ওয়াটার স্প্রে করতে হয়। ওদের উঠার আগে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এভাবে সময়ক্ষেপণ করতে পারলে অনেক সময় উদ্ধার করার মানুষ চলে আসে।'
নৌবানিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘আমরা জাহাজ মালিকদের বলেছি যে ভবিষ্যতে যাতে আর্মড গার্ড নিয়ে যায়। এবং স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস যেগুলো আছে, সেগুলো মেইনটেইন করে যাতে সতর্কতার সাথে জাহাজ পরিচালনা করে।’
এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে এস আর শিপিং কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই সাগরে ঘুরতে থাকা জলদস্যু বাহিনীর কবলে পড়েছে তাদের জাহাজ। উপকূল থেকে ৫শ নটিক্যাল মাইল দূরে জলদস্যুর অবস্থান চমকে দেওয়ার মতো বলেই দাবি তাঁদের।
প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া পরামর্শক মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘সুযোগ যখন যে জাহাজের উপর পেয়েছে সে জাহাজেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে। আমাদেরকে টার্গেট করার কোনো কারণ আছে বলে আমরা মনে করছি না। হুতিদের আক্রমণের একটা বিষয় যেহতু এসেছে আবার সবার মনোযোগ যেহতু ওদিকে তখন তারা (জলদস্যু) এই সুযোগটা নিয়ে তাদের পরিধিটা বাড়িয়েছে। ওই অঞ্চল থেকে আমাদের জাহাজটা আক্রমণ করেছে।’
বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ কার্গো জাহাজ ভারত মহাসাগর হয়ে আফ্রিকা ও আমেরিকাতে পণ্য পরিবহন করে। এক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিহারের কোন সুযোগ নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পাইরেসি জোনের পরিধি বাড়ায় এখন এ রুটে পরিবহন খরচ, যন্ত্রপাতি কেনার ব্যয় ও বীমার প্রিমিয়াম কয়েক গুণ বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
সমুদ্র পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১০ বছরে ভারত মহাসাগরে প্রায় ৮০টি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। জলদস্যুদের অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বেড়েছে। পরিবর্তন হয়েছে হামলার কৌশল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বীমা প্রতিষ্ঠান। যারা জাহাজে জলদস্যু বীমা থেকে ১০ গুণ বেশি আয় করে।
নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর বলছে, গত পাঁচ বছরে এ রুটে পাইরেসি কমে আসায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন না জাহাজ মালিক। তবে গেল বছরের নভেম্বরের পর এ রুটে ৫টি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়ে জাহাজ মালিকদের পরামর্শ দিয়েছে অধিদপ্তর।
নৌবাণিজ্য অধিদপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, 'গত ৪-৫ বছরে এ ধরনের ঘটনা কমে গিয়েছিলো। কিন্তু ২-৩ মাস যাবত এটা হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই জাহাজ মালিকদের আমর্স গার্ড সঙ্গে নিতে হবে।'
ওশান বিয়ন্ড পাইরেসি নামক গবেষণা সংস্থা বলছে, সোমালিয় জলদস্যুদের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে জাহাজ চলাচলে বছরে খরচ বেড়েছে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।