পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত মানুষের ওপর চালানো সেই সেনা অভিযানের সাংকেতিক নাম বা কোডনেম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। সে রাতের অভিযানে ঢাকায় প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। সেই রাতটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্ণনা করা হয় ‘ভয়াল কালরাত্রি’ হিসেবে। তবে সেই রাতের নীল নকশা আঁকা হয়েছিল আরও এক সপ্তাহ আগে।
‘অপারেশন সার্চলাইটের’ পরিকল্পনা যেভাবে করা হয়েছিল
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সময়টা তখন রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঢাকা তখন বিক্ষোভের শহর। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনে ওড়ানো হলো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরপর ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন, যেখানে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল।
সেদিনের ভাষণের পর কয়েকদিন কেটে গেল চাপা উত্তেজনায়। ১৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে এলেন আলোচনার নামে। তবে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা মনমতো না হওয়ায় টিক্কা খান রাও ফরমান আলী ও জেনারেল খাদিম হাসান রাজাকে মিলিটারি অ্যাকশনের প্রস্তুতি নিতে বলেন।
২০১২ সালে পাকিস্তানি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’ নামে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
স্মৃতিচারণমূলক সেই গ্রন্থে খাদিম হুসাইন লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে কমান্ড হাউজে ডেকে পাঠান।
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের উপদেষ্টা। দুজন সেখানে যাওয়ার পর টিক্কা খান তাঁদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় ‘প্রত্যাশিত অগ্রগতি’ হচ্ছে না।যে কারণে এখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশনে’র জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
খাদিম হুসাইন রাজা লিখেছেন, ‘(পরিকল্পনা হলো) ফরমান ঢাকা সেনানিবাসের অভিযান তত্ত্বাবধান করবেন, আর আমাকে দেওয়া হবে এর বাইরে গোটা প্রদেশের দায়িত্ব। এরপর অভিযানের ভূমিকা, আর ঢাকায় কী করে অপারেশন চলবে, তা ফরমান লিখলেন।...আগের আয়োজন অনুযায়ী, আমরা আবার ১৮ মার্চের বিকেলে কমান্ড হাউজে মিলিত হই। সেখানে চূড়ান্তভাবে, আমি প্রস্তাব ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করি। কোনো আলোচনা ছাড়াই এই পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়।’
পাঁচ পৃষ্ঠার ওই পরিকল্পনাটি রাও ফরমান আলী নিজ হাতে লেখেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২৪-২৫ মার্চ জেনারেল হামিদ, জেনারেল এ ও মিঠঠি, কর্নেল সাদউল্লাহ হেলিকপ্টারে করে বিভিন্ন সেনানিবাসের প্রস্তুতি পরিদর্শন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ২৫ মার্চ রাত ১টায় অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় অভিযানে ঢাকায় নেতৃত্ব দেবেন রাও ফরমান আলী। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নেতৃত্ব দেবেন খাদিম রাজা। আর টিক্কা খান ৩১ ফিল্ড কমান্ডে উপস্থিত থেকে অপারেশনের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবেন।
অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তা হলো—
১. একযোগে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশন শুরু হবে।
২. সর্বাধিকসংখ্যক রাজনীতিক ও ছাত্রনেতা, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার চরমপন্থীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
৩. ঢাকার অপারেশনকে শতকরা ১০০ ভাগ সফল করতে হবে। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করতে হবে।
৪. সেনানিবাসের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
৫. যাবতীয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগমাধ্যম বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রেডিও, টিভি, টেলিপ্রিন্টার সার্ভিস, বৈদেশিক কনস্যুলেটসমূহের ট্রান্সমিটার বন্ধ করে দিতে হবে।
৬. ইপিআর সৈনিকদের নিরস্ত্র করে তদস্থলে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের অস্ত্রাগার পাহারায় নিয়োগ করতে হবে এবং তাদের হাতে অস্ত্রগারের কর্তৃত্ব দিতে হবে।
৭. প্রথম পর্যায়ে এ অপারেশনের এলাকা হিসেবে ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেটকে চিহ্নিত করা হবে। চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর ও কুমিল্লায় প্রয়োজনে বিমানযোগে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
অপারেশন সার্চলাইটে ঢাকা শহরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ উপরিউক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত নেয়:
১. পিলখানায় অবস্থিত ২২নং বেলুচ রেজিমেন্ট বিদ্রোহী ৫ হাজার বাঙালি ইপিআর সেনাকে নিরস্ত্র করবে এবং তাদের বেতার কেন্দ্র দখল করবে।
২. আওয়ামী লীগের মুখ্য সশস্ত্র শক্তির উৎস রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ৩২নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এক হাজার বাঙালি পুলিশকে নিরস্ত্র করবে।
৩. ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট শহরের হিন্দু অধ্যুষিত নবাবপুর ও পুরান ঢাকা এলাকায় আক্রমণ চালাবে।
৪. ২২নং বালুচ, ১৮ ও ৩২নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বাছাই করা একদল সৈন্য আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী শক্তিকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (জহরুল হক হল), জগন্নাথ হল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াকত হল আক্রমণ করবে।
৫. বিশেষ সার্ভিস গ্রুপের এক প্লাটুন কমান্ডো সৈন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি আক্রমণ ও তাঁকে গ্রেপ্তার করবে।
৬. ফিল্ড রেজিমেন্ট দ্বিতীয় রাজধানী ও সংশ্লিষ্ট বসতি (মোহাম্মদপুর-মিরপুর) নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
৭. শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশে এম ২৪ ট্যাংকের একটি ছোট্ট স্কোয়াড্রন আগেই রাস্তায় নামবে এবং প্রয়োজনে গোলা বর্ষণ করবে।
৮. উপর্যুক্ত সৈন্যরা রাস্তায় যেকোনো প্রতিরোধ ধ্বংস করবে এবং তালিকাভুক্ত রাজনীতিবিদদের বাড়িতে অভিযান চালাবে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সকাল থেকেই পাক আর্মি তাদের নতুন–পুরোনো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হতে শুরু করে। পরিকল্পনা অনুসারে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে, রাত ১টায় আক্রমণ শুরুর কথা থাকলেও ২৫শে মার্চ রাত ১১টার দিকে মিলিটারিরা ফার্মগেটে বাধা পায়, ব্যারিকেড এবং বিদ্রোহীদের দমনে গুলি চালায়। ফলে পূর্ব নির্ধারিত সময়ের আগেই অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়ে যায়।
আর এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা…
তথ্যসূত্র:
বাংলাপিডিয়া, ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’, পাকিস্তানি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর: যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট’, সাইয়েদা আক্তার, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস