১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, রাত ১১টা। হঠাৎ জারি করা কারফিউয়ের মধ্যে শহরের সব টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন, বন্ধ রেডিও সম্প্রচার। থমথমে এমন রাতের আধারে সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলো মেজর জেনারেল খাদিম রাজার অধীনের ৫৭ নম্বর ব্রিগেডের ৫টি রেজিমেন্ট। ক্লান্তিকর দিনের শেষে নিরীহ শহর তখন গভীর ঘুমের অপেক্ষায়।
ঢাকার ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, নীলক্ষেতজুড়ে হঠাৎই যখন ঘরঘর আওয়াজ তুলে হানাদারদের ট্যাংকের ছোটাছুটি, ঠিক সে সময়ই খবর আসে ১০ দিন ধরে আলোচনা নামের প্রহসন শেষ করে, গোপনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে গেছেন। করাচি বিমানবন্দরে নিরাপদেই অবতরণ করেছে তাকে বহনকারী বিমানটি!
বালুচ কসাই নামে খ্যাত তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাত থেকে ২৬ মার্চ ভোর পর্যন্ত চলা এই গণহত্যার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলো তিনটি। শুরুতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে গ্যাসোলিন ছিটিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। পাকিস্তান আর্মির আরেকটি দল নিয়ন্ত্রণ নেয় পিলখানায়, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর সদর দপ্তরের। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যুগপৎ আক্রমণ চালায় ১৮ ও ৩২ নম্বর পাঞ্জাব এবং ২২ নম্বর বেলুচ রেজিমেন্ট। যার নেতৃত্বে বালুচ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল তাজ।
রাতের আঁধারে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে নিরীহ ছাত্রদের ওপর গণহত্যা চালানোর এমন নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ২৫ মার্চ কালরাতে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো তার পূর্ণাঙ্গ কোন তালিকা পাওয়া যায় না, তবে জগন্নাথ হলের এই নামফলকে ৬৬ জনের নাম রয়েছে এবং মনে করা হয় বিভীষিকার সে রাতেই হলটিতে নৃশংসতা হয়েছে সবচেয়ে বেশি ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিতে ২৫ মার্চ কালরাতে হত্যা করা যে ১৯৫ জনের তালিকা পাওয়া যায়, তাতে এই হলের ৯ জন রয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, নিহতের এই সংখ্যা এর অনেক বেশি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক টিক্কা খানের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের বয়ান, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলোর জরিপ করছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিলো। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা। কিন্তু কোনো অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিলো না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো, ‘অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, পাকিস্তানিরা বেশকিছু এলাকাকে গণহত্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিল। বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট বেছে নেয়া হয়েছিল।’
গবেষক কাওসার চৌধুরী বলেন, ‘২৫ মার্চের আক্রমণ ঢাকায় যতোটা ভয়াবহভাবে হয়েছে অন্যান্য স্থানে সেভাবে হয়নি। এই আক্রমণের মাধ্যমে আমাদের মাঝে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল। যাতে আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধের দিকে যেন এগিয়ে যেতে না পারি।’
কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর ও চট্টগ্রামসহ পাকিস্তানী সৈন্য সমাবেশ আছে এরকম প্রতিটি শহরেই ২৫ মার্চের কালরাতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিলো। গবেষকরা মনে করেন, সেদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়, যদিও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই।
কাওসার চৌধুরী আরও বলেন, সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তারা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। চুকনগরের মানুষের দাবি, সেখানে একদিনে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আর এতোবড় হত্যাকাণ্ড হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক মহল এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে পারছে না।’
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেরিতে হলেও গণহত্যার শিকার শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা সময়ের দাবি। তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে আসা উচিত, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন ভূখণ্ডের ইতিহাস অন্বেষণ করা।