বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ২৫ ও ২৬ মার্চ তারিখ দুটি অমোচনীয় কালির মতো লেপ্টে আছে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন এ দুটি তারিখ ‘জন্মদাগ’ হিসেবে থেকে যাবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতকে বলা হয় ‘কালরাত্রি’। ওই রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিত গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পরদিন ২৬ মার্চ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। তবে তার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর এ স্বাধীনতার ঘোষণা ও তার আগের রাতের নৃশংস গণহত্যার খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ঠাঁই পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংকলক অভ্রনীল যাত্রী তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুস ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স থ্রো দ্য ওয়ার্ল্ড মিডিয়া’ শীর্ষক সংকলনে বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৭ ও ২৮ মার্চে বিশ্বের অন্তত ৯০টি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার খবর প্রকাশিত হয়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধের তথ্য নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’ নামে সংকলন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট আর্কাইভ: ১৮৮৪–১৯৭৮’ নামে সংকলন রয়েছে। সংকলনটিতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ‘‘আর্মড রেবেলিয়ন রিপোর্টেড’’ শিরোনামে নয়াদিল্লি থেকে একটি খবর প্রকাশ করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। খবরটিতে লেখা হয়েছিল—গতকাল পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি শহর থেকে যুদ্ধের খবর পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে একটি রেডিও স্টেশন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার করা হয়েছে।’
বলে রাখা ভালো, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ঘোষণাপত্র ২৬ মার্চ রাতেই তৎকালীন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেতারের চট্টগ্রামের কয়েকজন কর্মী শহর থেকে অনেকটা দূরে নিরাপদ জায়গা হিসেবে কালুরঘাটে বেতার থেকে সম্প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান।
যা হোক, ২৫ মার্চের গণহত্যা ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস ওইদিন একাই ৭টির বেশি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
২৭ মার্চ মার্কিন সংবাদমাধ্যম টাইমস–এ ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী নেতা আটক’ শিরোনামে প্রতিবেদন লিখেছিলেন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের নয়াদিল্লি সংবাদদাতা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান রেডিও আজ জানিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
অপর এক প্রতিবেদনে রয়টার্সকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম পাকিস্তানেও। সেখানে লায়লপুরে (বর্তমানে ফয়সলাবাদ) সংঘটিত সহিংতা আজ (২৭ মার্চ, ১৯৭১) নিয়ন্ত্রণে এনেছে পুলিশ। পুরো এলাকায় ২৪ ঘণ্টা কাফিউ জারি করা হয়েছে। ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে খবর প্রকাশ করছে রেডিও পাকিস্তান।’
একই দিনে ‘কামানের গোলাবর্ষণ: ঢাকায় বেসামরিকদের ওপর গুলি, বিভিন্ন জায়গায় আগুন’ শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রতিবেদন লেখেন সিডনি এইচ শ্যানবার্গ। এই সাংবাদিক লিখেছিলেন—‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের ওপর কামানের গোলা ছুড়েছে এবং মেশিনগান দিয়ে গুলি করেছে। অঞ্চলটিতে অন্তত সাড়ে সাত কোটি মানুষ বাস করে।’
এসব খবর প্রকাশের মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে ‘মার্কিন সহায়তায় শক্তিশালী হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। ওই প্রতিবেদনে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা উইলিয়াম বেচার বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের আশঙ্কায় পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অচিরেই সৈন্য সংখ্যা বাড়াবে বলে মনে করনে মার্কিন বিশ্লেষকেরা।’
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি প্রতিবেদনে বলেছে, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ইতিমধ্যে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী শেখের বাহিনীর (শেখ মুজিবুর রহমান) সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় আজও যুদ্ধ করছে বলে জানা গেছে।
মার্কিন সাময়িকী টাইম ‘পাকিস্তান সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সরকার ঢাকায় ২৪ ঘণ্টার কারফিউ জারি করেছে। যারাই কারফিউ ভাঙছে, তাদেরই গুলি করছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৭ মার্চ ‘বাংলাদেশ স্বাধীন’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছেপেছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধে হতাহত বাড়ছে। অন্তত ছয়টি সেনানিবাস ঘিরে ফেলেছে পিন্ডির সৈন্যরা। শেখ মুজিবুর রহমান এরই মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর কবল থেকে দেশকে পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।
২৭ মার্চ দ্য আইরিশ টাইমস ‘পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার ঘোষণা: ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, একটি গোপন রেডিও স্টেশন থেকে গত রাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ চলছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে।
একই দিনে বার্তা সংস্থা এপির তোলা একটি ছবি প্রকাশ করে মিশিগান ডেইলি। ছবির গল্পের শিরোনাম ছিল ‘বিপ্লবের ডাক’। আর ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল—‘পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় বুধবার একটি সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে আন্দোলনে নামার আহ্বান জানান। গতকাল এই নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’
২৭ মার্চ খবর প্রকাশ করেছিল আয়ারল্যান্ডভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আইরিশ ইন্ডিপেনডেন্ট। তাদের খবরের শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানে রক্তের বন্যা’।
আগের দিন ২৬ মার্চ ব্যাংকক পোস্ট লিখেছিল ‘গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটির উপশিরোনাম ছিল ‘পূ্র্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় সেখানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’
কানাডাভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য উইন্ডসর স্টার ২৭ মার্চ একটি খবর প্রকাশ করে। খবরের শিরোনাম ছিল—‘শহরে বোমা ফেলেছে সরকারি উড়োজাহাজ: গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে পূর্ব পাকিস্তান’।
একই দিনে দ্য ট্রান্সক্রিপ্ট নামের সংবাদপত্র ‘স্বাধীনতার ঘোষণা: পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও–ভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য ব্রায়ান টাইমস ২৭ মার্চে লিখেছিল—‘পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহীদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে আজ প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেখানে বিদ্রোহীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন থেকে প্রকাশিত পত্রিকা দ্য বুলেটিনের শিরোনাম ছিল—‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত শুরু’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজ পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
‘পাকিস্তানে হাজার হাজার নিহত’ শিরোনামে ২৭ মার্চ খবর প্রকাশ করেছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ ইনডিপেনডেন্ট। ওই প্রতিবেদনে পত্রিকাটি বলেছে, ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়া আজ পূর্ব পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে হাজার হাজার নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা বেসামরিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক দ্য সানডে মর্নিং হেরাল্ড ২৯ মার্চ ‘বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছিল। খবরে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে, তা জানা অসম্ভব। রেডিও পাকিস্তানের মতে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী...।’
একই দিনে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্র দ্য এজ ‘পাকিস্তান ট্র্যাজেডি’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছেপেছিল। ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর ছেপেছিল স্কটিশ ট্যাবলয়েড দ্য ইভিনিং টাইমসও। তারা জানিয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধে ১০ হাজার নিহত হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেখানকার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে।
আইরিশ প্রেস লিখেছিল, পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আ ফ ম সাঈদ তাঁর ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস’ বইতে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টের একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। ওই সংকলনে বলা হয়েছে, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে খবর প্রকাশ করেছিল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। বিবিসি জানিয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গোপন বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।’
ভয়েস অব আমেরিকা জানিয়েছিল, ‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।’
দিল্লি থেকে প্রকাশিত স্টেটসম্যানের খবর ছিল এমন—‘পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানের প্রতিবাদে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এক গোপন বেতার ভাষণে পাকিস্তানের পূর্বাংশের নাম “স্বাধীন বাংলাদেশ” বলে ঘোষণা করেছেন।’
লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৭ মার্চ লিখেছিল—‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ: শেখ একজন বিশ্বাসঘাতক, বলেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট’। অন্যদিকে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছিল—‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেন। এরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন অন্য এক ব্যক্তি।’
এসব সংবাদমাধ্যমের বাইরেও ভারতের আরও বেশ কয়েকটি পত্রিকা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, হংকং, নরওয়ে, জাপান, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ও ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর।