যুক্তরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি কয়েক দশক ধরে মুসলমানদের জোরালো সমর্থন পেয়ে থাকলেও এবার তাতে ভাটা নেমেছে। মূলত গাজায় ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলা ও চলমান যুদ্ধের মধ্যে লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারের ইসরায়েলপন্থী অবস্থানের জেরে এমনটি হয়েছে।
তীব্র সমালোচনা উপেক্ষা করে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো থেকে বিরত ছিলেন স্টারমার। গত বছর ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর পর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থানে অনঢ় ছিলেন এই লেবার নেতা।
দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৫৮টি স্থানীয় কাউন্সিল ওয়ার্ডে, যেখানে বাসিন্দাদের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি মুসলমান, সেখানে ২০২১ সালের নির্বাচনের তুলনায় লেবারদের ভোট ২১ শতাংশ কমে যায়। মঙ্গলবার (১৪ মে) সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সিতে প্রকাশিত সাংবাদিক মেহমেত সোলমাজের নিবন্ধে এসব বলা হয়েছে।
নিবন্ধে বলা হয়, পার্টির কর্মকর্তারা এই বিষয়টি আমলে নিয়ে তড়িঘড়ি বিবৃতি দেন। তারা মুসলিমদের ভোট ও সমর্থন ফিরে পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। তাদের লক্ষ্য লেবাররা পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। ২০২৫ সালের জানুয়ারির পরে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
লেবার পার্টির ডেপুটি ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর এবং (ছায়া মন্ত্রিসভা) শ্যাডো ক্যাবিনেটের সদস্য এলি রিভস স্বীকার করেন, মুসলিম ভোটারদের সমর্থন ও আস্থা ফিরে পেতে দলের 'অনেক কাজ করতে হবে'।
'গাজায় কী ঘটছে তা নিয়ে আমি মানুষের উদ্বেগ অনুধাবন করতে পারছি। সেখানে যেভাবে প্রাণহানি হয়েছে তা অসহনীয়। সে কারণেই আমরা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছি,' বিবিসি ব্রেকফাস্টকে এমনটি জানিয়েছেন তিনি।
গত অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে লেবার পার্টির অনিচ্ছা ও গড়িমসির কারণে দলটির প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের সন্দেহ এখনও কাটেনি।
গাজা ইস্যুতে ব্রিটিশ ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্যসহ কয়েক ডজন সিনিয়র ব্যক্তিত্বের পদত্যাগের পরে অবশেষে দলের অবস্থানগত পরিবর্তন আসে। প্রায় ৭০ জন লেবার এমপি দলীয় নীতি ভঙ্গ করে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। প্রায় ১০০ জন কাউন্সিলর দলীয় পদ থেকে সরে দাঁড়ান। যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের অনেকেই হয় অন্য বিরোধী দলে যোগ দিয়েছেন বা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
লেবার পার্টি কীভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে ফের সংযোগ স্থাপন ও আস্থা ফিরে পাবে জানতে চাইলে, স্টারমার প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। প্রসঙ্গ পাল্টে জোর গলায় তিনি বলেন, 'তাদের দল স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে সারাদেশে দুর্দান্ত ফল অর্জন করেছে।'
তিনি বলেন, 'পার্টির কাজ হচ্ছে যেসব জায়গায় হেরে গেছে সেখানে পরবর্তীতে জয়লাভের চেষ্টা করা।
মুসলিম ভোটারদের সঙ্গে পুনঃসংযোগের নির্দিষ্ট প্রশ্নে আবারও চাপ দেয়া হলে, স্টারমার ফের টালবাহানা করেন এবং বলেন, 'যেখানে আমরা ভোট পাইনি … আমরা সেগুলো ফিরে পেতে লড়াই করবো।'
গাজায় বসবাসরত লক্ষাধিক ফিলিস্তিনির বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ করার 'অধিকার' ইসরায়েলের রয়েছে। এমন মন্তব্য করার পর স্টারমার তীব্রভাবে জনরোষের শিকার হন।
কয়েকদিনের নীরবতার পর, লেবার নেতা যুক্তি দেখান, তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষা এবং জিম্মিদের উদ্ধারের অধিকার রয়েছে যা 'আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে' পড়ে।
'আমি বলছিলাম যে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, এবং যখন আমি বলেছিলাম, তখন আমি বলতে চেয়েছিলাম যে এটি আত্মরক্ষার অধিকার। আমি বলি নাই যে গাজায় পানি, খাদ্য, জ্বালানি বা ওষুধ বন্ধ করার অধিকার রয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর,' তিনি যুক্তি দেখান।
স্টারমারের বিতর্কিত বিবৃতি এবং যুদ্ধবিরতির আহ্বান নাকচ করার পরপরই পদত্যাগের ঝড় উঠে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কেনসিংটন ও চেলসির কাউন্সিলর মোনা আহমেদ।
গত অক্টোবরে তার পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার সময়, মোনা আহমেদ আনাদোলু এজেন্সিকে বলেছিলেন, ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল (কনজারভেটিব পার্টি) এবং তার দল (লেবার পার্টি) দুই দলের করা মন্তব্যই 'দুঃখজনক ও ঘৃণিত' ছিল।
'কেউ ভুলে যাবে না যে কীভাবে স্টারমার যুদ্ধাপরাধের দোসর হওয়া বেছে নিয়েছিলেন। তিনি সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি গণহত্যা চালানো অপশক্তির সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। আরব এবং মুসলিম সম্প্রদায় এটি কখনই ভুলতে পারবে না।’ তুর্কি-ব্রিটিশ সাংবাদিক মেহমেত সোলমাজের নিবন্ধটি বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন।