নাজুক হচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গত বছরের এ সময়ের তুলনায় বেড়েছে আক্রান্তও। এ অবস্থায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এডিস নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছেটানোর দাবি করলেও, ওষুধ কেনার প্রক্রিয়া চলার কথা জানাচ্ছে উত্তর সিটি করপোরেশন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বছরজুড়েই থাকবে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
এডিস মশার বাড়বাড়ন্ত দেখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গত বছরই বার্তা দিয়েছিলেন, মশা বাগে আনতে না পারলে ডেঙ্গু এবার হবে আরও ভীতিকর। তবে সেই সতর্কবার্তা কোনো সংস্থার কানে পৌঁছেনি। এডিস মশা যেসব সংস্থা বশে আনবে, তাদের খামখেয়ালি এবারও চোখে পড়ার মতো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা; সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা অন্য কোনো সংস্থা তা নিচ্ছে না। এ কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
গত বছর ৬৪ জেলাতেই এডিস মশার অস্তিত্ব ও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গিয়েছিল। এবারও দেশজুড়ে এডিস মশার বিস্তার থাকলেও জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বসে আছে হাত গুটিয়ে। মশা নিয়ন্ত্রণে ২০২১ সালে একটি জাতীয় নির্দেশিকা প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, সেই জাতীয় নির্দেশিকার নামই শোনেননি বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি।
নির্দেশিকায় বলা আছে, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যরা তাঁর ওয়ার্ডের মশার বিস্তার নিয়ে প্রতি মাসে ইউপি চেয়ারম্যানকে জানাবেন। দেশের অন্তত ছয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কেউই মশার খোঁজ রাখার বিষয়টিই জানেন না।
বরিশালের আগৈলঝাড়ার বাকাল ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রাজ্যেশ্বর রায়। তিনি তিনবারের ইউপি সদস্য। তিনি বলেন, ‘মশা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদ আমার কাছে কোনো সময় জানতে চায়নি। আমিও মশার বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন কাউকে দিইনি। কখনও আমাকে কোনো সভায় ডাকা হয়নি, বরাদ্দও দেওয়া হয়নি। তবে আমার এলাকায় ভালোই মশা আছে।’
মানিকগঞ্জের শফিউদ্দীন মোল্লা। পেশায় আসবাব ব্যবসায়ী। মাসখানেক ধরে জ্বর। মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে আসার পর শনাক্ত হয় ডেঙ্গু।
এমন শারীরিক অবস্থা নিয়ে মানুষ রোজই আসছে মুগদা হাসপাতালেও। কেউ শনাক্ত হয়ে আসছে বা কেউ এসে ডেঙ্গুতে শনাক্ত হচ্ছেন। চলতি মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে ভর্তি হন ১১৯ জন।
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের এপ্রিলে ডেঙ্গু রোগী ছিল ৬৮ জন। এ বছরের একই সময়ে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৫ জনে। আর এই সময়ে মারা গেছেন চারজন।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘এপ্রিল মাসে ২১৫ জনকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। চলতি মে মাসের এই সময় পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ১১৯ জনকে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।’
রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এই তথ্য স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এখন বছরজুড়েই থাকছে ডেঙ্গু।
অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান, সারা বছর জুড়ে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকছে। যার ফলে গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
মশক বিশেষজ্ঞ সাইফুর রহমান বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে। এখানে মশার ওষুধের মান নিয়েও রয়েছে সমস্যা। সিটি করপোরেশন গতানুগতিক পদ্ধতিতে কাজ করে। যখন যেখানে মশা পায়, সেখানে স্প্রে করে। মশা বাড়লে শোভাযাত্রা করে। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ব্লকভিত্তিক সার্ভিলেন্স দল গঠন করতে হবে। কোথা থেকে মশা ও রোগী আসছে, সেখানে অভিযান চালাতে হবে। মশা পাওয়া গেলে সেটাকে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করতে হবে, তার শরীরে ভাইরাস আছে কিনা। এ যাচাই পদ্ধতিও এখানে নেই। মাঠ পর্যায়ের সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। কোথাও সার্ভিলেন্স টিম নেই। ক্লাস্টার (ঘাঁটি) চিহ্নিত করা হয় না বলে মশা নিয়ন্ত্রণও করা যায় না।
এদিকে, এডিস মারতে নিয়মিত ওষুধ ছেটানোর কথা জানাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে ওষুধ কেনার প্রক্রিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে উত্তর সিটি।
উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মশা মারার ওষুধ কিন্তু আমরা ঠিক করি না। আমরা কী ধরনের ওষুধ আনব তা বিভিন্ন বিভাগ মিলে ঠিক করে দেয়। ওষুধ আনার কার্যক্রম চলছে।’
দক্ষিণ সিটি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শেখ ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম চলছে। ১ হাজার ৫০ জন মশক কর্মী। কেউ কাজে ফাঁকি দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মশক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কী কাজ করছে, তার মূল্যায়ন প্রকাশ্যে করা মুশকিল। তবে ডিএনসিসি তো কিছু একটা করছে। কিন্তু দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তো কিছুই করছে না।
তবে এ ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ডিএসসিসি গত ১ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেছে। মশারি বিতরণ, কাউন্সিলরদের মাধ্যমে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সচেতনতামূলক কার্যক্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম আমরা নিয়েছি। নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম লার্ভিসাইডিং, এডাল্টিসাইডিং কার্যক্রম চলমান। আগে থেকেই এত ভীতি ছড়ানো ঠিক নয়।
ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর আগেই ১২ মে পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছেন ২ হাজার ৪৬০ জন। এ পরিসংখ্যানই বলছে, এবারও মানুষের মনে কাঁপন ধরাবে ডেঙ্গু। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সরকারের গণনাতেই সারাদেশে প্রাণ যায় ১ হাজার ৭০৫ জনের। তবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি।