ঝরে পড়া রোধে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অবকাঠামোর অভাব ও শিক্ষক সংকট এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে দ্রুতই বাস্তবায়নের তাগিদ শিক্ষাবিদদের। তারা বলেছেন, সাড়ে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫ হাজার স্কুল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে হবে। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নেয়া হবে জেলাভিত্তিক সিদ্ধান্ত।
এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার শিক্ষার্থী। এই একই ব্যাচ যখন ২০১৮ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দেয় তখন তাদের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ ৯৫ হাজার। অর্থাৎ একটি ব্যাচ থেকেই মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়েছে প্রায় ১১ লাখ শিক্ষার্থী।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের বড়ইবাড়ী আলহাজ্ব কছিমউদ্দিন ইনস্টিটিউট ও কলেজ। জরাজীর্ণ টিনের ঘরে পড়াশোনা করা এখানকার অনেক শিক্ষার্থীই ঝড়ে পড়েছেন মাধ্যমিক পর্যায়ে। কেউ ছিটকে গেছেন পারিবারিক অস্বচ্ছলতায় বাল্যবিয়ের কারণে, আবার অনেকে ঝড়ে পড়েছেন পরিবারের আর্থিক সংকটে কাজে জড়িয়ে পড়ার কারণে। অথচ, প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিকেও স্বল্পমূল্যে পড়ার সুযোগ মিললে, তাদের জীবনের গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো।
বড়ইবাড়ী আলহাজ্ব কছিমউদ্দিন ইনস্টিটিউট ও কলেজের অধ্যক্ষ ( ভারপ্রাপ্ত) সুশীল চন্দ্র সরকার বলেন, 'শিশু শ্রমের দিকে চলে যায়। ফলে তারা স্কুল থেকে ছিটকে পড়ে। অনেক সময়ে মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয়ে যাচ্ছে।'
শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, 'গ্রামের অনেক মেয়েদের বাসায় সমস্যা থাকে পড়ালেখা করতে পারে না। স্কুলে আসতে পারে না।'
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের আগেই অর্ধেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া রোধে নিম্নমাধ্যমিক তথা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি বাস্তবায়ন হলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বা নামমাত্র বেতনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে।
অভিভাবকদের একজন বলেন, 'যদি বিনা বেতন পড়ার সুযোগ পায় তাহলে অনেক ছেলে-মেয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পাবে।'
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ স্পষ্ট বলা আছে, দেশের প্রাথমিক শিক্ষা হবে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত। যা বাস্তবায়নে ২০১১ সালেই কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাবে পিছিয়ে পড়ে সেই উদ্যোগ। এখন ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৬৯৫টিতে আছে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত। এখন প্রশ্ন- কীভাবে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হবে?
শিক্ষাবিদরা বলছেন, নিম্নমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাকে বিনামূল্যে করতে এখন বড় চালেঞ্জ অবকাঠামোর অভাব ও শিক্ষক সংকট। তবুও, শিক্ষার্থদের স্বার্থে দ্রুতই তা বাস্তবায়নের তাগিদ।
শিক্ষা বিশ্লেষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'অনেক সমালোচনা আসবে কিন্তু সরকার তার জায়গায় স্ট্রং থাকতে হবে। এখনকার স্কুলে যে অবকাঠামো সেখান ক্লাস রুম বাড়াতে হবে ধীরে ধীরে।'
এদিকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত মিড ডে মিল বাস্তবায়নেরও পরামর্শ এই শিক্ষা বিশ্লেষকের।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সাদেকা হালিম বলেন, 'মিড ডে মিল যেটা চালু করা হয়েছিল সেটা কিন্তু সব জায়গায় নেই। সেটাকে পুনরায় চালু করা এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলে মেয়ে ধরে রাখার জন্য এইটা চালু রাখা প্রয়োজন।'
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, আগামী ৩ বছরের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যকরের লক্ষ্য সরকারের। এই সময়ের মধ্যে আরও ১ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হবে। এ জন্য সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালুর প্রয়োজন হবে না।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, 'আমরা যদি ৫ হাজারের কাছাকাছি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করতে পারি এবং সেখানে যদি অবৈতনিক করে দিতে পারে তাহলে কিছুটা বাস্তবায়ন হবে।'
আর শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরি বলছেন, অবৈতনিক শিক্ষার জন্য নেয়া হবে জেলাভিত্তিক সিদ্ধান্ত।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, 'যেসমস্ত জেলায় নূন্যতম খরচে নিম্নমাধ্যমিক নেয়া যাচ্ছে সেখানে আমাদের হস্তক্ষেপ করতে হবে না এবং যেসমস্ত জেলায় বেশি নেয়া হচ্ছে খরচ সেখানে অবৈতনিক কার্যক্রম শুরু করতে হবে।'
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হতে যেখানে সময় লেগেছে ১৫ বছর, সেখানে আগামী ৫ বছরে তা পূরণের লক্ষ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।