০৮:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আকস্মিক বন্যায় সিলেটে সাড়ে ৫লাখ মানুষ পানিবন্দি

আকস্মিক বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জের অনেক এলাকা এখন বন্যাকবলিত। পানিবন্দি অবস্থায় আছেন প্রায় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২০২ জন মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের তথ্যমতে, শুক্রবার (৩১ মে) সকাল ৬টায় সিলেটের কানাইঘাট সুরমা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জকিগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদীর অমলসিদ পয়েন্টে ২০৯ সেন্টিমিটার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য দুটি পয়েন্ট গোয়াইনঘাটের জাফলং ডাউকি পয়েন্ট ও সারি গোয়াইন পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে।

এই বন্যায় অনেকেই যেমন হারিয়েছেন ঘরবাড়ি তেমনি বানের পানিতে ভেসে গেছে গৃহপালিত পশুসহ খামারের মাছও। কৃষি জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে । সংশ্লিষ্টরা বলছেন অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির বিষয় ছাড়া শুধুমাত্র মৎস্য ও কৃষি সম্পদের ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকার নিচে নয়। আর জেলা প্রশাসন জানিয়েছে আপাতত দুর্গত এলাকার মানুষকে নিরাপদ রাখাই তাদের লক্ষ্য।

কুশিয়ারা নদীর ১০ স্থানে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে বিয়ানীবাজারের গ্রামের পর গ্রাম। এছাড়া সারি ও বড়গাঁও নদী উপচে পানি ঢুকতে শুরু করেছে লোকালয়ে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার (৩০ মে) পর্যন্ত দুর্গতদের জন্য খোলা হয়েছে ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র।

সিলেটে পাহাড়ি ঢলের প্রভাব এখনো ফুরোয়নি, কোথাও বাঁধ ভেঙ্গে গর্জন সুরে শুন্য হাওর ভরাট হচ্ছে পানিতে আবার কোথায় মূল সড়ক উপচে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ইতোমধ্যে ২ দিনের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি অবুঝ প্রাণির জান-মালের সাথে ক্ষত-বিক্ষত করছে ৭ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলকে।

জেলা প্রশাসনের সূত্রমতে, সিলেট জেলায় ৫৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি উপজেলার ৩৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাকবলিত এলাকার ৪ হাজার ৮০২ জন লোক আশ্রয় নিয়েছে। প্লাবিত উপজেলাগুলোর মধ্যে কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, শুকনো খাবার ও অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। বন্যার কারণে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর আবাদি জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যাদুর্গত পরিবারের সংখ্যা ৪২ হাজার ৯০০টি এবং মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫০। যদিও বন্যাকবলিত মানুষ ৫ লাখ হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলার জনপ্রতিনিধিরা।

জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, বন্যার্তদের জন্য আপাতত হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ৭৫ টন চাল ও আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ত্রাণের সমস্যা হবে না।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার কুদরত উল্লাহ, পেশায় মাছ চাষি। বছরের শুরুতে ধারদেনা করে কয়েক লাখ টাকার মাছ চাষ করেন এই খামারি। কিন্তু আকস্মিক বন্যার পানিতে পুকুরের মাছের সাথে ভেসে যায় তার সকল স্বপ্ন। এখন তিনি কেবল নিঃস্ব, কেবল অসহায়।

কুদরত উল্লাহ বলেন, ‘হঠাৎ করে পানি এসেছে। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে পানি এসে সব নিয়ে গেছে। মাছ আটকানোর অবস্থা পায়নি।’

কুদরত উল্লার মতো সীমান্ত অঞ্চলের হাজারো মাছ চাষির কণ্ঠে এখন সম্পদ হারানোর সুর, কারো লাখ, কারো বা কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে এই দুর্যোগে। সিলেট জেলা মৎস্য অফিস বলছে, দু’দিনে প্রায় দেড় কোটি চাষের পোনা আর আনুমানিক ৮শ’ টনের মতো মাছ বন্যায় ভেসে গেছে, যার ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ২৫ কোটি টাকার মতো।

মাছ চাষি আরেকজন বলেন, ‘বন্যার কারণে আমাদের অনেক এলাকার পুকুরে মাছ ভেসে গিয়েছে। যারা খামারি আছে তাদের প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’

ঢলের ঘোলা জলে কেবল যে মৎস্য সম্পদই নষ্ট হয়েছে তাই নয় বরং অনেকেই নিজের জমিনের চাষকৃত আউশ ধান, বীজ, নাগামরিচ, কাচাঁ মরিচসহ হারিয়েছেন হাজার হাজার একর জমির শাকসবজি ও ফসল।

কৃষক একজন বলেন, ‘সব পানিতে ডুবে গিয়েছে। কিছু নেই এখন।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে এই অকাল বন্যায় ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির উৎপাদিত ফসল বিনষ্ট হয়েছে, যা থেকে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বিবেচনা করলে শুধু কৃষকদেরই ক্ষতি হয়েছে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।

সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘টোটাল ক্ষতি কি হয়েছে কৃষকের কাছে এটা কিছু না তাদের কাছে অল্প ক্ষতি মানেই বড় ক্ষতি। এই বন্যা যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে।’

এদিকে জেলা প্রশাসক বলছেন অবকাঠামোগতসহ সার্বিক ক্ষতি নিরূপণ করা না গেলেও বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘জেলা পর্যায় থেকে যা যা করণীয় আমরা তা করে যাচ্ছি। দুর্যোগ মোকাবিলায় যা যা প্রয়োজন দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে সহায়তা দেয়া হবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। তবে, পাহাড়ি ঢল বন্ধ হলে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে।

আকস্মিক বন্যায় সিলেটে সাড়ে ৫লাখ মানুষ পানিবন্দি

আপডেট : ১১:৩৭:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ মে ২০২৪

আকস্মিক বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জের অনেক এলাকা এখন বন্যাকবলিত। পানিবন্দি অবস্থায় আছেন প্রায় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২০২ জন মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের তথ্যমতে, শুক্রবার (৩১ মে) সকাল ৬টায় সিলেটের কানাইঘাট সুরমা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জকিগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদীর অমলসিদ পয়েন্টে ২০৯ সেন্টিমিটার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য দুটি পয়েন্ট গোয়াইনঘাটের জাফলং ডাউকি পয়েন্ট ও সারি গোয়াইন পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে।

এই বন্যায় অনেকেই যেমন হারিয়েছেন ঘরবাড়ি তেমনি বানের পানিতে ভেসে গেছে গৃহপালিত পশুসহ খামারের মাছও। কৃষি জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে । সংশ্লিষ্টরা বলছেন অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির বিষয় ছাড়া শুধুমাত্র মৎস্য ও কৃষি সম্পদের ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকার নিচে নয়। আর জেলা প্রশাসন জানিয়েছে আপাতত দুর্গত এলাকার মানুষকে নিরাপদ রাখাই তাদের লক্ষ্য।

কুশিয়ারা নদীর ১০ স্থানে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে বিয়ানীবাজারের গ্রামের পর গ্রাম। এছাড়া সারি ও বড়গাঁও নদী উপচে পানি ঢুকতে শুরু করেছে লোকালয়ে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার (৩০ মে) পর্যন্ত দুর্গতদের জন্য খোলা হয়েছে ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র।

সিলেটে পাহাড়ি ঢলের প্রভাব এখনো ফুরোয়নি, কোথাও বাঁধ ভেঙ্গে গর্জন সুরে শুন্য হাওর ভরাট হচ্ছে পানিতে আবার কোথায় মূল সড়ক উপচে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ইতোমধ্যে ২ দিনের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি অবুঝ প্রাণির জান-মালের সাথে ক্ষত-বিক্ষত করছে ৭ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলকে।

জেলা প্রশাসনের সূত্রমতে, সিলেট জেলায় ৫৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি উপজেলার ৩৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাকবলিত এলাকার ৪ হাজার ৮০২ জন লোক আশ্রয় নিয়েছে। প্লাবিত উপজেলাগুলোর মধ্যে কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, শুকনো খাবার ও অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। বন্যার কারণে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর আবাদি জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যাদুর্গত পরিবারের সংখ্যা ৪২ হাজার ৯০০টি এবং মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫০। যদিও বন্যাকবলিত মানুষ ৫ লাখ হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলার জনপ্রতিনিধিরা।

জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, বন্যার্তদের জন্য আপাতত হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ৭৫ টন চাল ও আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ত্রাণের সমস্যা হবে না।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার কুদরত উল্লাহ, পেশায় মাছ চাষি। বছরের শুরুতে ধারদেনা করে কয়েক লাখ টাকার মাছ চাষ করেন এই খামারি। কিন্তু আকস্মিক বন্যার পানিতে পুকুরের মাছের সাথে ভেসে যায় তার সকল স্বপ্ন। এখন তিনি কেবল নিঃস্ব, কেবল অসহায়।

কুদরত উল্লাহ বলেন, ‘হঠাৎ করে পানি এসেছে। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে পানি এসে সব নিয়ে গেছে। মাছ আটকানোর অবস্থা পায়নি।’

কুদরত উল্লার মতো সীমান্ত অঞ্চলের হাজারো মাছ চাষির কণ্ঠে এখন সম্পদ হারানোর সুর, কারো লাখ, কারো বা কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে এই দুর্যোগে। সিলেট জেলা মৎস্য অফিস বলছে, দু’দিনে প্রায় দেড় কোটি চাষের পোনা আর আনুমানিক ৮শ’ টনের মতো মাছ বন্যায় ভেসে গেছে, যার ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ২৫ কোটি টাকার মতো।

মাছ চাষি আরেকজন বলেন, ‘বন্যার কারণে আমাদের অনেক এলাকার পুকুরে মাছ ভেসে গিয়েছে। যারা খামারি আছে তাদের প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’

ঢলের ঘোলা জলে কেবল যে মৎস্য সম্পদই নষ্ট হয়েছে তাই নয় বরং অনেকেই নিজের জমিনের চাষকৃত আউশ ধান, বীজ, নাগামরিচ, কাচাঁ মরিচসহ হারিয়েছেন হাজার হাজার একর জমির শাকসবজি ও ফসল।

কৃষক একজন বলেন, ‘সব পানিতে ডুবে গিয়েছে। কিছু নেই এখন।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে এই অকাল বন্যায় ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির উৎপাদিত ফসল বিনষ্ট হয়েছে, যা থেকে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বিবেচনা করলে শুধু কৃষকদেরই ক্ষতি হয়েছে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।

সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘টোটাল ক্ষতি কি হয়েছে কৃষকের কাছে এটা কিছু না তাদের কাছে অল্প ক্ষতি মানেই বড় ক্ষতি। এই বন্যা যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে।’

এদিকে জেলা প্রশাসক বলছেন অবকাঠামোগতসহ সার্বিক ক্ষতি নিরূপণ করা না গেলেও বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘জেলা পর্যায় থেকে যা যা করণীয় আমরা তা করে যাচ্ছি। দুর্যোগ মোকাবিলায় যা যা প্রয়োজন দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে সহায়তা দেয়া হবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। তবে, পাহাড়ি ঢল বন্ধ হলে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে।