এবারও সংস্কৃতি খাতে সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বাজেট পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অসন্তুষ্টি জানিয়েছে তাঁরা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭৭৯ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরে এই খাতে সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৫ কোটি টাকা বেশি। এর আগে গত অর্থবছর এই খাতে প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৬৯৯ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা হয় ৭৬৪ কোটি।
তবে দীর্ঘদিন ধরেই সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১ শতাংশ করার দাবি করে আসছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। ফলে এবারও হতাশাই বিরাজ করছে সংস্কৃতি অঙ্গনে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বললেন, ‘এবারের বাজেটটি আমরা দেখেছি এবং এটিও মোটামুটি অন্যান্য বারের মতো একই ধরনের বাজেট। প্রতিবারই মূল জাতীয় বাজেটের আকার বৃদ্ধি পায়, সেই অনুযায়ী ২০-৩০ কোটি টাকা সংস্কৃতি খাতেও বাড়ে। এতে আমূল কোনো পরিবর্তন নেই। আমরা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যে কথাটি বিগত দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছি—যদি একটা সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তুলতে হয়, তাহলে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক ও নীতি-আদর্শ বোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে হবে। আর তা তৈরি হতে পারে একমাত্র শিক্ষা ও সংস্কৃতির জাগরণের মধ্যে দিয়ে। সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে যেমনভাবে ধারণ করতে হবে, পাঠাভ্যাস বাড়াতে হবে, একইসঙ্গে সংস্কৃতি চর্চার পরিধিকেও বিস্তৃত করতে হবে। গ্রাম-প্রধান এই বাংলাদেশে তৃণমূলকে বাদ দিয়ে কোনো অর্জন সম্ভব নয়। যে কারণে আমরা বলছি, গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত যদি একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তুলতে হয়, তাহলে উপজেলা পর্যায়ে মহড়ার সুযোগ-সুবিধাসহ অন্তত একটা করে মিলনায়তন, একটা করে মুক্তমঞ্চ অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে। প্রত্যেক জেলায় একটা করে আধুনিক মিলনায়তন, অন্তত একটা মুক্তমঞ্চ থাকা দরকার; যেখানে মহড়ার সুযোগ-সুবিধা থাকবে। খোদ রাজধানীতে শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক তিন-চারটি মিলনায়তন ছাড়া সরকারি উদ্যোগে এই ঢাকা শহরে কোনো মিলনায়তন নেই যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতে পারে। মিরপুর, বারিধারা, গুলশান, উত্তরা, মালিবাগ, বাসাবো, যাত্রাবাড়ি—কোথাও মিলনায়তন নেই।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সারাদেশে আধুনিক মিলনায়তন ও মুক্তমঞ্চ নির্মাণ। এর পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চার জন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। বিষয়গুলো উল্লেখ করে গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘সাংস্কৃতিক জাগরণের জন্য আমাদের প্রথম দায়িত্ব হলো দেশব্যাপী সংস্কৃতি চর্চার জন্য আধুনিক মিলনায়তন ও মুক্তমঞ্চ নির্মাণ। দ্বিতীয়ত হলো প্রশিক্ষণ। গ্রামে-গঞ্জে যে সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিল্পীরা সংস্কৃতি চর্চায় আগ্রহী তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও চারুকলায় স্থায়ী প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা আমরা বলে এসেছি। যারা এই শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষিত করবে।’
শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক তিন-চারটি মিলনায়তন রয়েছে, অন্য কোথাও নেই বলে জানান গোলাম কদ্দুছ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
তিনি আরও বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে দুই-আড়াই হাজার টাকা বেতনে অবৈতনিক প্রশিক্ষক রয়েছে, এভাবে তো সংস্কৃতি চলবে না। এই দুটো দাবি হলো আমাদের সার্বজনীন দাবি। মোটাদাগে এই দুটো দাবির একটা দাবিও বাস্তবায়িত হওয়ার কোনো লক্ষ্যণ আমরা এবারের বাজেট বক্তৃতায় দেখিনি। তাহলে কীভাবে দেশব্যাপী একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তুলবেন? বাজেটে যেসব খাতের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর প্রয়োজন তো আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা বলছি সংস্কৃতিসেবীদের ভাতা বৃদ্ধির জন্য। সারাদেশে হাজার হাজার বাউলশিল্পী, লোকশিল্পী, যাত্রাশিল্পী আছেন। এর মধ্যে হাতেগোনা ৪ হাজার শিল্পীকে অনুদান দেওয়া হয়। তাও সেটা ১২০০-১৩০০ টাকা থেকে শুরু! আজকের যুগে কি এই টাকায় কোনো একজন শিল্পীর সংসার চলতে পারে? আমরা বলছি যে এটা যৌক্তিক পর্যায়ে হওয়া উচিত।’
অন্যবারের মতো এবারের বাজেট নিয়েও হতাশা প্রকাশ করে এই সংস্কৃতিজন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক একজন মানুষ। এবং তিনি বারবার এর গুরুত্বের কথা বলেও এসেছেন। কিন্তু তারপরও কী কারণে সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে না, বরং সেই একই জায়গায় থেকে যাচ্ছে আমরা তা জানি না। এবারের বাজেটে আমরা খুবই আশাহত এবং হতাশ।’
এছাড়া প্রতি বছর সংস্কৃতি খাতে যে বাজেট বরাদ্দ হয়, তার ব্যয়েও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে দেশের সংস্কৃতি মহলে। এ প্রসঙ্গের কথা বললে, বাজেট প্রণয়নের আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অংশীজনদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা করে না বলে জানান গোলাম কদ্দুছ।
তিনি বলেন, ‘একটা মন্ত্রণালয়ে যখন বাজেট পরিকল্পনা করা হয়, তখন তারা তাদের অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসে। কিন্তু আমরা যারা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত, বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে—আমাদের কারও সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাজেট প্রণয়নের পূর্বে কোনোদিনও আলাপ-আলোচনা করেনি। আমরা দেখি টাকার অভাবে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না, অথচ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা ফেরত যায়! সেটা কীভাবে? এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে যারা এটির দায়িত্বে রয়েছেন তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।’
প্রসঙ্গত, আজ বিকেলে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ শীর্ষক বাজেট বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য তিনি ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন।