পেনশন স্কিমে আগ্রহ কম নিম্নআয়ের মানুষের
- আপডেট সময় : ০১:৩২:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ জুন ২০২৪
- / ৩৯১ বার পড়া হয়েছে
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে গেল ১০ মাসে ২ লাখ ৬৯ হাজার গ্রাহক হিসাব খুলেছেন। এর বিপরীতে জমা হয়েছে ৭৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, যা প্রত্যাশার চেয়ে কম। এই স্কিম নিয়ে সরকারের অনেক প্রত্যাশা থাকলেও নাগরিকদের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। আস্থা অর্জনের পাশাপাশি বৈষম্য দূর করা গেলে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, সবার কাছে নতুন এই ধারণার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কাজ করছে তারা।
শুধু নিম্ন আয়ের মনুষ নয়, সরকারি পেনশন আওতার বাইরে থাকা সকল নাগরিকের জন্য গেল বছর সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করলেও এখনও সাড়া পড়েনি, জানেন না অনেকেই। যারা জানেন তাদের মধ্যেও রয়েছে আস্থাহীনতা। আর স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার জন্য জুলাই থেকে চালু হতে যাওয়া প্রত্যয় স্কিম বন্ধে ইতোমধ্যে সোচ্চার অনেকেই।
দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি বিভাগে প্রায় ১০ বছর ধরে কর্মরত আছেন শেখ আনোয়ারুল ইসলাম। সর্বজনীন পেনশনে নেতিবাচক ধারণার মধ্যেই নতুন বিতর্ক রয়েছে প্রত্যয় স্কিমে। তার কাছে পেনশন মানে চাকরি শেষে এক সাথে নির্দ্দিষ্ট অংকের টাকা পাওয়া। দেশে নতুন চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে তার ভাবনা কি?
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘চাকরি শেষে একট সুবিধা পাওয়ার জন্য চাকরি করি যে এই সুবিধা নিয়ে যেন চলে যেতে পারি। বা আমি যদি মারা যাই, তখন আমার স্ত্রী বা সন্তনি এ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তবে নতুন যে স্কিম চালু হয়েছে, এতে আগের সুবিধাগুলো কেটে ফেলা হয়েছে।’
দেশের বেসরকারি খাতে কর্মরতদের একটি বড় অংশেরই মাসিক বেতন আর উৎসব ভাতা ছাড়া নেই কোনো প্রোভিডেন্ড ফান্ড কিংবা পেনশন সুবিধা। চাকরি ছাড়লে পান না এককালীন কোনো টাকাও। শ্রম জরিপ অনুযায়ী, দেশে কাজে নিয়োজিতদের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত। গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, দেশে মাত্র ১০ ভাগ বেসরকারি চাকরিজীবীর প্রভিডেন্ট বা গ্রাচ্যুইটি সুবিধা আছে। তবুও গেল দশ মাসে জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে আছে পেনশন স্কিম প্রকল্প। যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণও নগণ্য।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘প্রথমে এই পেনশনের ধারণাটা সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পষ্ট ছিল না। আমরা যখস বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি করে দু’টি মেলা করেছি তখন অনেকে জানতে পেরেছে। এটা নিয়মিত করতে পারলে আমরা মনে করি এই পিনশন করার হার বাড়তে থাকবে।’
গেল বছরের আগস্টে বেসরকারি চাকরিজীবী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত কর্মী, স্বল্প আয়ের মানুষ এবং প্রবাসীদের অংশ নেয়ার সুযোগ রেখে চারটি আলাদা স্কিমের ঘোষণা দেয় সরকার। যেখানে গেল ১০ মাসে ২ লাখ ৬৯ হাজার গ্রাহক হিসাব খুলেছেন। যেখানে জমা হয়েছে ৭৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা যার ৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ইতোম্যধ্যে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আস্থা অর্জনের পাশাপাশি বৈষম্য দূর করা গেলে বাড়বে এর গ্রহণযোগ্যতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘চারটা স্কিম একধরনের না। স্কিমে যে নিরাপত্তা থাকে তা বৃদ্ধ বয়সে একে ধরনের হবে। কর্তৃপক্ষ একটা এভারেজ হিসাব করেছেন, এভারেজ হিসাব অনেক সময় মানুষকে মিসলিড করে দেয়। ভবিষ্যতে কি ধরনের কাজ হবে, সে আশাবাদ মানুষকে দিতে হবে, না হলে এ থেকে স্থায়ী ইনকামের নিশ্চয়তার জায়গাটা তাদের বোঝাতে হবে।’
এছাড়া এ স্কিমে সাধারণ নাগরিকের আস্থা অর্জনে আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর আওতায় আনা দরকার ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তীরে এসে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকেন খেয়াঘাটের মাঝি রুহুল আমিন মাইজভান্ডারি। ২০ বছর ধরে চলছে তার এ নিয়ম, ২০ টাকায় নদীর খেয়া পাড়ি দেয়ার জীবন। তার কাছে সঞ্চয় বলতে বিলাসিতা, যেখানে সংসারে নিয়মিত চলে টানাপড়োন।
রুহুল আমিন বলেন, ‘নদী ভাঙ্গনে ভিটে-বাড়ি হারিয়ে সব নিয়ে ঢাকায় চলে আসছি। এসে কোনোকিছু করতে পারিনি। এই নৌকা চালায়া ২০০ থেকে ৪০০ টাকা কামাই করি। যেদিন নৌকা চালাতে পারি না, সেদিন অনেক কষ্ট করে চলতে হয়।’
ষাটোর্ধ্ব খেয়া মাঝি, দিনমজুর কিংবা বয়োজেষ্ঠোর কাছে বার্ধক্যের ভরণপোষন বলতে ছেলে-মেয়ে কিংবা উত্তরসূরীর বাড়িয়ে দেয়া হাত। সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তাদের কতটুকু আশ্রয় দিয়েছে?
একজন দিনমজুর বলেন, ‘এতটা যিপিএস আছে, একটা গরু পালি আর এর সাথে এই তো প্রতিদিন মজুরের কাজ করি। ২ থেকে ৩ বছর পরে অন্য চিন্তাভাবনা করবো। হয়তো বাইরে চলে যাব।’
যাদের আয় সর্বনিম্ন, বছরে মোটে ৬০ হাজার টাকা, তারাই সর্বজনীন পেনশনে সমতায় আসবেন দ্বিগুন বিনিয়োগে। এক হাজার টাকার সঞ্চয়ে অর্ধেক দেবে সরকার। সমতার এ সহজ হিসাব কতটা সহজ নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে?
অন্য একজন দিনমজুর বলেন, ‘এখন বয়স আছে প্রতিদিন কাজ করে খাচ্ছি। কিন্তু যখন ৬০ বছর বয়স হয়ে যাবে তখন তো কাজ করতে পারবো না। এখন ডিপিএস করলে চালাতে পারবো কিন্তু তখন তো চালাতে পারবো না।’
উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলে মাটি কতটা স্পর্শ করেছে পেনশন স্কীম? রাজশাহীর তানোরের পঁচাপুকুর গ্রামে দুপুরের খাবারের সময় হওয়ায় চাল থেকে পাথর-কাকর বাঁছতে মগ্ন থাকেন রিনা বিবি।
বেছে রাখা চালের সবটুকু পাতিলে না চড়িয়ে এক মুঠো রাখেন আলাদা করেই। প্রতিদিনের জমানো এ চাল গুচ্ছ হয়ে অসময়ের অবলম্বন হয় অনটনের সংসারে।
রিনা বিবি বলেন, ‘এখাবে চাল জমিয়ে রাখলে মাঝেমধ্যে যখন ঘরে চাল থাকে না, তখন কারও কাছে যেতে হয় না। আবার চাল জমিয়ে যখন ৫ থেকে ৬ কেজি হয়, তখন এটা বিক্রি করে মুরগী কিনি পালার জন্য।’
গৃহের নারীদের মতো হাটে, অফিস-আদালত কিংবা পাড়া-মহল্লায় সমিতি, লটারি বা জমা নামে সঞ্চয়ের প্রবনতাও আছে বহুপুরনো। সঞ্চয়ের জন্য এসব মাধ্যম যতটা উৎসাহের আধুনিক পদ্ধতি কেন তাদের কাছে ততটা পিছিয়ে?
রাজশাহীর স্থানীয় একজন বলেন, ‘কোন মাধ্যমে জমা দিতে হবে বা কিভাবে কি করতে হবে, এটা নিয়ে তো কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি এখনও। আমরা কি করে বুঝবো, কোথায় গিয়ে কি করবো?’
জাতীয় পেনশন স্কিমের প্রচারনার পর রাজশাহী বিভাগে স্কিম ভূক্তি ২৬ হাজারের বেশি হলেও বিভাগে মানুষের বাস ২ কোটির বেশি। গণশুমারি ২০২২ এর তথ্যমতে বিবিএস বলছে যেখানে রাজশাহী বিভাগে নির্ভরশীলতার অনুপাত ৪৮.৮৯ শতাংশ। জাতীয় পেনশন স্কিম এই নিরর্ভরশীলতা কমাতে সহায়ক হলেও কেন এখনও মন্থর জনসাধারণের অংশগ্রহণ!
স্থানীয় একজন বলেন, ‘নতুন একটা জিনিস আসলে তারসাথে তাল মেলাতে সময় লাগে। আগে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতো না। কিন্তু এখন সবাই কিন্তু ব্যাংকে যাচ্ছে। নতুন বিষয়ে আমাদের তো একটা সময় দিতে হবে।’
রাজশাহী ও বগুড়ায় স্কিম ভূক্তির সংখ্যা বাড়লেও অনেকটা স্থির বিভাগের অন্য ৬টি জেলায়। যেখানে সবচেয়ে এগিয়ে সমতা, পর্যায়ক্রমে সুরক্ষা ও প্রগতি, আর প্রবাস স্কিম তলানিতে যার গ্রাহক সংখ্যা মাত্র ১৬। সবমিলিয়ে প্রায় ৭ কোটি টাকা জমা হয়েছে পুরো রাজশাহীতে।