আওয়ামী লীগের লড়াই সংগ্রাম ও ঘুরে দাঁড়ানো
- আপডেট সময় : ১১:৫৯:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ জুন ২০২৪
- / ৩৮১ বার পড়া হয়েছে
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার হওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেয়ার কারণে গ্রেপ্তার হওয়া শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে এই সংগঠনের প্রাতিষ্ঠাতা যুগ্মসাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২৭ জুন তিনি আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে জেল থেকে বের হন। নিজের দূরদর্শিতা এবং নেতৃত্বগুণে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই দলের অপরিহার্য মুখ হয়ে পড়েন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের উদ্যোগে প্রাদেশিক দল থেকে পুরো পাকিস্তানের জাতীয় দলে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ। ভাষা আন্দোলনে সামনে থেকে ভূমিকা রাখার কারণে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে বিভিন্ন অযুহাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতো। দলকে গুছিয়ে জাতীয় দলে পরিণত করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জনমত সৃষ্টি করছে এই ভয় থেকে ১৯৫০ সালে শেখ মুজিবকে আবারো গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬ মাস পর ১৯৫২ সালের এপ্রিলে জেল থেকে বের হয়ে দেশের অধিকাংশ জেলায় রাজনৈতিক সফর করেন তিনি। পাকিস্তানীদের নানা ষড়যন্ত্র ও জেল-জুলুমকে ডিঙিয়ে প্রায় চার মাসব্যাপী নিরলস পরিশ্রম করে সারাদেশের কমিটি পুনর্গঠন করে তরুণ নেতা শেখ মুজিব মাত্র ৩২ বছর বয়সে দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের পোস্টারে পরিণত হন তিনি।
১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে (পূর্ব পাকিস্তান) আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল সরকার গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের কারণে মাত্র দুই মাসের কম সময় ব্যবধানে, ১৯৫৪ সালের ৩১ মে, যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হয়। শেখ মুজিবসহ পূর্ব পাকিস্তান আইনপরিষদের ৩৫ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায় এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি বাংলার মানুষের গণরায়ের ওপর ভিত্তির করে, ১৯৫৫ সালের ২২-২৩ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটিকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাদেশিক পরিষদের সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবকে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ ও গ্রামীণ সহায়তাবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু দুলকে শক্তিশালী করার জন্য মে মাসের শেষে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। দেশজুড়ে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগেক শক্তিশালী করার কাজে নিমগ্ন হয়ে যান তিনি।
১৩ মাস সরকার পরিচালনার পর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রের কারণে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন হয়। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক আইন জারি করেন তিনি। ১২ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবকে। দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দখল নেন সেনাপ্রধান আইয়ুব খান। জেল থেকে বের হয়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর, একক নেতৃত্বে দলকে পুনর্জীবন প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের সাহসী উদ্যোগে ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সব জেলায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক বছরের রাজনৈতিক স্থবিরতা ভেঙে এক নতুন আওয়ামী লীগের পথচলা শুরু হয়।
১৯৬৬-১৯৭১:
১৯৬৬ সালের ১৮ ও ১৯ মার্চের কাউন্সিলে শেখ মুজিবকে সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠিত হয়। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করের আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। দেশজুড়ে ছয় দফার পক্ষে গণপ্রচারণা শুরু হলে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ও রাজনীতিকরা অস্ত্রের ভাষায় এই গণজাগরণ মোকাবিলার চেষ্টা করলে এর প্রতিবাদে ৭ জুন হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। বিপরীতে সেদিন ১৪৪ ধারা জারি করে পাকিস্তানিরা। কিন্তু ছাত্র-জনতার পাশাপাশি শ্রমিকরাও রাজপথে নেমে আসে ছয় দফার সমর্থনে। জান্তাদের গুলিতে প্রাণ হারায় ১১ জন। এরপর গণগ্রেপ্তার শুরু হয়। একের পর এক আটক হতে থাকেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এসব গ্রেপ্তার, হত্যা ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে মাত্র দেড় মাসে বিভিন্ন জেলায় ৩২টি জনসভা করেন শেখ মুজিব। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘমেয়াদে জেলে রাখা হয়। ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আবুল হাসনাত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক এই ছয় দফার পরপরই বাংলার রাজনীতির গতিপথ বদলে যায়। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির একমাত্র কণ্ঠস্বর। আর আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে স্বাধীনতার অমিয় স্বাদ এনে দেওয়ার মতো একটি মাত্র দল। কারণ ছয় দফায় ছয়টি দাবি থাকলেও মূল দাবি আসলে ছিল একটি, আর সেটি হলো বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি।
ছয় দফার গণজাগরণে ভীত হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বঙ্গবন্ধুর অসম সাহসী নেতৃত্ব ও গগনচুম্বি জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে ১৯৬৮ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর নামে দায়ের করা হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য’ নামের একটি মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা)। এসময় দেশজুড়ে মানুষ স্লোগান দিতে থাকে ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একসঙ্গে একাকার হয়ে যেতে থাকে বাঙালির মানসপটে। প্রবল জনরোষের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সামরিক সরকার। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার বিমূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই গণ-আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হয়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে একচ্ছত্র হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগ।
১৯৭০-১৯৭১:
জেল থেকে বের হয়ে সাত কোটি জনতাকে সাথে নিয়ে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ তোলেন বঙ্গবন্ধু। প্রচণ্ড গণদাবির মুখে ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি জান্তারা। সেই নির্বাচনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একচেটিয়াভাবে ভোট দেয় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে। যার ফলে, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংরক্ষিত ৭ আসনসহ ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে সরাসরি ভোটে জিতে পুরো পাকিস্তানের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে সংরক্ষিত ১০ আসনসহ ৩১০টি আসনের মধ্যে সরাসরি ভোটে ২৯৮টি আসন লাভ করে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার একমাত্র আস্থার জায়গা অর্জন করে বাংলার জনগণের কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র করে জনগণের রায়কে প্রত্যাখান করার পাঁয়তারা করতে থাকে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কৌশলে দেশবাসীকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দেশজুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি অঘোষিত কিন্তু বিকল্প সরকার পরিচালিত হতে শুরু করে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আর কোথাও পাকিস্তান সরকারের কোনো আদেশ মানা হলো না। সব স্থান থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে উড়ানো হয় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজের নিশান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম পরিষদ।
কিন্তু এরমাঝেই সকল নিয়ম-নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে ২৫ মার্চের কাল রাতে ঘুমন্তু বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি জান্তারা। ফলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। এর পরপরই গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের নির্জন জেলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আপামর বাঙালি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের মুক্তাঙ্গনে শপথ নেন তারা। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ ও উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দায়িত্ব নেন। অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে দিয়ে গঠন করা হয় স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে রণাঙ্গন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে মহান বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন মহাকাব্যের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাত ধরে হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে মহান স্বাধীনতা।
১৯৭২-১৯৮১:
আওয়ামী লীগের হাত ধরে হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে মহান স্বাধীনতা। জাতির পিতার নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ সম্পদ নিয়ে চলতে থাকে অবকাঠামো নির্মাণ। দীর্ঘমেয়াদে সুন্দর জাতি গড়ার লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয় বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা। এরমধ্যেই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা হয় সংবিধান। জাতীয় ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে “বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে” ঘোষণা করা হয় জাতীয় চার নীতি হিসেবে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে অনেক অভ্যন্তরীণ দুর্বত্তায়ন এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশকে প্রায় গুছিয়ে আনেন তিনি। কিন্তু এরমধ্যেই বাংলার আকাশে নামে দুর্ভোগের ঘনঘাটা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে খুনি মোশতাক-জিয়া চক্র নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে । স্বৈরশাসকদের হিংস্র থাবায় বিক্ষত হতে থাকে সোনার বাংলা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। ঠিক তেমনি এক ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ই ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
সেদিন রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা শহর মিছিল আর স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিও সেদিন লাখ লাখ মানুষের মিছিলকে গতিরোধ করতে পারেনি। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পরিণত হয় জনসমুদ্রে। স্বাধীনতার অমর স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃ হত্যার বদলা নেব’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে আমরা আছি তোমার সাথে’। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’।
শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই স্বাধীন বাংলার মাটিতে আবারো নবজীবন লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ছয় বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে স্বৈরাচার ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে আবারো রাজপথে সক্রিয় হয়ে ওঠে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগ।
১৯৮১-২০০১:
সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরা পর কয়েক বছর ধরে সারা দেশের প্রতিটি প্রান্ত ঘুরে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তব জীবনচিত্র উপলব্ধি করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, একই সঙ্গে বহুমুখী প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পিতা মুজিবের হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগকে নতুনভাবে সুসংগঠিত করে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে নব্বইয়ের দশকে তীব্র স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। এসময় গণতন্ত্রের পথে এগোতে থাকা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে থামিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র সফল করার জন্যে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়, প্রাণ ঝরে শতাধিক নেতা-কর্মীর। দেশ বিরোধী অপশক্তি ও স্বৈরাচ্চারের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র, হামলা এবং বুলেট-বোমার ভয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিচলিত না হয়ে জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন আরো জোরদার করেন। ফলশ্রুতিতে পতন ঘটে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার। কিন্তু সুক্ষ্ম কারচুপি ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের কারণে সংখ্যায় বেশি ভোট পেয়েও আসন সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। তখন আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে বিরোধী দলের আসনে বসে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন শেখ হাসিনা। ফলে বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় গণতন্ত্র বাস্তবায়নে বাধ্য হন খালেদা জিয়া। রাজপথে শেখ হাসিনার সাহস ও জনপ্রিয়তা এবং তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সুদৃঢ় অবস্থান দেখে ভীত হয়ে পড়ে খালেদা জিয়ার সরকার। একারণে স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের লোক দেখানো ভোটের স্টাইলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি নাটকীয় ভোট করে জোর করে ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা করে বিএনপি। কিন্তু প্রহসনের এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে রাজপথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন খালেদা জিয়া। এরপর জুন মাসের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। অদম্য শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে।
প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই অন্ধকারে নিমজ্জিত দেশকে এগিয়ে নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করতে কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৯৯ সালে খাদ্য উৎপাদনে প্রথমবারের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। সরকার গঠনের পর গঙ্গা নাদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ১৯৯৬ সালেই নিশ্চিত করেন। ১৯৯৭ সালে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের জন্য সম্পাদন করেন ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি। এছাড়াও সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিঃস্বার্থ সেবাদানের কারণে ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ মোকাবিলার মডেলে পরিণত করেন। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে ষড়যন্ত্র, কারচুপির ও ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে আবারো আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়।
২০০১-২০০৮:
৫ বছর দেশ পরিচালনার পর ২০০১ সালের ১৩ই জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এরপরই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। সারাদেশে শুরু হয় হামলা-খুন-নির্যাতন। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে দেশ। পরবর্তী ৫ বছর প্রতিহিংসার নির্মমতা দেখেছিল বাংলাদেশ, ভয়ে শিউরে উঠেছিল মানুষ। দেশে আইনের শাসন ছিল না। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়কে তাই আখ্যা দেয়া হয়েছিল ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ নামে।
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসেই চিরতরে আওয়ামী লীগকে খতম করার পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওপর শুরু হয় নৃশংস ও নির্মম নির্যাতন। বাংলাদেশকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে ‘একাত্তরের এদেশীয় ঘাতক-দালাল ও তাদের উত্তরসূরী এবং পৃষ্ঠপোষকদের’ দ্বারা গঠিত সেই সরকার। বিএনপি-জামায়াত সবসময় আওয়ামী লীগকে তালেবানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘু, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর রাষ্ট্রীয় মদদে নৃশংস নির্যাতনের ৪০৯২টি ঘটনা ঘটে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের পত্রিকাগুলোর সংবাদ শিরোনামেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগের সমাবেশ বা কর্মসূচির আগে গণগ্রেপ্তার করা হতো। একেক দিনে ৮-১০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবের হোসেন চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সেলিম সামাদ, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনের মতো ব্যক্তিদের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। সমাবেশে গ্রেনেড ছুড়ে আহসানউল্লাহ মাস্টার এবং শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যার মতো সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশ হলেই রাষ্ট্র্রীয় মদদে পুলিশি অ্যাকশন শুরু হয়ে যেত। কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পেটানো হতো কুকুরের মত। এমনকি নারী নেত্রীদের শরীর থেকে কাপড় খুলে নেয়ার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে এই বিএনপি-জামায়াত। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টে আওয়ামী লীগের ডাকা সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা সারাবিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। সে যাত্রায় গ্রেনেড হামলা থেকে অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু নেত্রী বেঁচে ফিরলেও এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী এবং এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা নিহত হন এবং আহত হন ৫শ’ জনেরও বেশি নেতা-কর্মী। নিহতদের মধ্যে ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ। এই সময়েই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৮ বারের বেশি চেষ্টা চালানো হয়। এজন্য বিএনপি-জামায়াত হুজি ও জেএমবির মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে এবং হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংসতার জন্য তাদের রাজনৈতিক নিরাপত্তাও প্রদান করে।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের মেয়াদ শেষ। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, নিয়ম অনুযায়ী একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা তাদের। কিন্তু লুটপাট অব্যাহত রাখার জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে খালেদা জিয়ার পরামর্শে, ২৯ অক্টোবর রাতে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন বিএনপি সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ফলে সৃষ্টি হয় সাংবিধানিক সংকট। এসবের প্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, সুশীল সমাজের ছদ্মবেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্য। মাইনাস টু ফর্মুলার নামে দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর অপচেষ্টা শুরু হয়। ১৬ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। মিথ্যা মামলায় ২০০৭ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে জেলে ঢোকানোর পর, একের পর এক মোট ১৩টি মামলা সাজানো হয় তার নামে। ২৪ জুলাই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। জেলে বন্দি অবস্থায় শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘদিন স্বজনদের সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা হয়। তার চিকিৎসা প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। গ্রেনেড হামলায় আহত কান ও চোখ চিকিৎসার অভাবে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। মানসিকভাবে শক্ত থাকলেও, শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাকে স্লো-পয়জনিং করা হচ্ছে বলেও আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তার অসুস্থতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যায়। অবশেষে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা টানা ২০ দিন চিকিৎসার পর তাকে আপাত স্বাভাবিক করে তোলেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এদিকে বিএনপি-জামায়াত চক্র এবং কতিপয় সামরিক সদস্য নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আটক ও হয়রানি শুরু হয়। ২০০৮ সালের ২৩ মে, আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলের ৭২টি সাংগঠনিক শাখার তৃণমূল নেতারা শেখ হাসিনার প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন এবং তাকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য দেশজুড়ে চলমান আন্দোলন জোরদার করার ঘোষণা দেন। ২৭ ও ২৮ মে, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় সিদ্ধান্ত হয়- শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের এই ঘোষণার পর দেশজুড়ে শুরু হয় গণগ্রেপ্তার। প্রায় ২০ হাজার মানুষকে জেলে ঢুকানো হয়। কিন্ত তবুও শেখ হাসিনার পক্ষে গণজোয়ার থামানো যায়নি। অবশেষে জননেত্রীর জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের সামনে কুচক্রীদের সব রকমের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ১১ জুন, বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা। জেল থেকে বের হয়ে, গণমানুষের ভাগ্য বদলের জন্য ‘দিন বদলের সনদ’ ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও দুঃসাহসী নেতৃত্বে ভর করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আয়োজিত জাতীয় নির্বাচনে একচেটিয়া জয় লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের জোট। জোটের মোট অর্জিত ২৬৭ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগই পায় ২৩০টি।
২০০৯-২০২৪:
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রেখে এবং সাফল্য ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে জনগণকে সাথে নিয়ে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে নিরলসভাবে কাজ করতে থাকা এই দলটিকে এরমাঝেও নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে যেয়ে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের অভয়রাণ্য বিএনপি-জামাত জোটের নানামুখী দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিলো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আদালতের মাধ্যমে আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সকল ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে যুদ্ধাপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করে বাংলার মাটিকে কলংকমুক্ত করেছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করে দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করার অপচেষ্টাও করেছে এই স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। ২০১৪ সালের ৫ই মে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে আগুন হরতাল, অবরোধের নামে অবৈধভাবে আগুন সন্ত্রাস ও বোমাবাজি করে অনেককে নিহত ও আহত করে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকার শক্তহাতে সেসবকে দমন করে দেশের মানুষের নিরাপত্তা ও দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে।
দক্ষিণ বঙ্গের মানুষের প্রাণের দাবী ও আমাদের স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণ বন্ধ করে দেশের অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ সহ বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে খুনি রাষ্ট্র ঈসরাইল ও তাদের মদদদাতা মার্কিনীদের নিয়ে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন বন্ধ করার অপচেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক আদালতে দুর্নীতির এই অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছিলো। এতোসব চক্রান্তের পরও বঙ্গবন্ধুকন্যা দমে যাননি। ২০১২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে অদম্য শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার কথা বলেন এবং সফলভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্পটি সফলভাবে সম্পন্ন করে ২৫ জুন ২০২২ এর শুভ উদ্বোধন করেন।
২০১৮ ও ২০২৪ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি-জামাত জোট নানামুখী চক্রান্ত করে। দেশী-বিদেশী সব ষড়যন্ত্রকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মোকাবেলা করে ২০১৮ ও ২০২৪ এর জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে এগিয়ে চলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের এই পথচলা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ছিল কণ্টকাপূর্ণ ও বিপদসংকুল। গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে প্রথমে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর অবর্তমানে তাঁরই সুযোগকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নীতি ও আদর্শে অবিচল, দৃঢ় ও সাহসী থেকে সুখে-দুঃখে- দুর্যোগে দুর্বিপাকে- সর্বদা গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে- হামলা, মামলা, আঘাত ও ষড়যন্ত্র সহ সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।