ঢাকা ১০:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

দেশে ৮৪ শতাংশই সিজারিয়ান বেসরকারিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ০১:৫১:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪
  • / ৩৭৩ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

হাসপাতালে প্রসবের হার বাড়ায় মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কিছুটা কমলেও ব্যাপকভাবে বেড়েছে সিজারিয়ান। খরচও গেছে নাগালের বাইরে। ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় সম্পন্ন হওয়া সিজারিয়ানের খরচ কোথাও কোথাও ২ লাখও ছুঁয়েছে। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান মায়ের শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি বাড়ালেও এর দায় নিচ্ছেন না কেউ। ১১ বছরে সিজারিয়ানের হার দ্বিগুণ হয়ে ৪৫ শতাংশে ঠেকেছে। যার ৮৪ শতাংশই বেসরকারিতে। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, শিগগিরই ৯০ শতাংশ ছাড়াবে।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০২২ এর তথ্য বলছে, ১১ বছরে সিজারিয়ানের হার দ্বিগুণ হয়ে ৪৫ শতাংশে ঠেকেছে। যেগুলোর ৮৪ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, রোগীদের স্বাভাবিক প্রসবে উদ্বুদ্ধ বা সহযোগীতা না করায় বেসরকারিতে সিজারিয়ানের হার শিগগিরই ৯০ শতাংশ ছাড়াবে।

ওজিএসবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘প্রত্যেকটা অপারেশনে জটিলতা রয়েছে। সিজারের কারণে অনেক রক্তক্ষরণ হতে পারে যার ফলে রোগী মারা যেতে পারে। আমাদের আরও অনেক সোচ্চার হওয়া উচিত যেন সিজারের হার কমিয়ে আনা যায়।’

তবে দেশের ইতিহাসে সিজারিয়ানের মাত্রা সর্বোচ্চ হবার দায় গাইনি পেশাজীবীদের সংগঠন ওজিএসবির ওপর চাপালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।

তিনি বলেন, ‘দুর্গম অঞ্চলে সিজারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে কেন সিজার হচ্ছে না। কিন্তু দেশে বেসরকারি সেক্টরে সিজারিয়ানের মাত্রা সর্বোচ্চ তা গাইনি পেশাজীবীদের সংগঠন ওজিএসবি উত্তর দিতে পারবে কেন এত বেশি।’

ঢাকায় হাসপাতালভেদে সিজারিয়ানের খরচ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যদিও অধিকাংশ মানুষের পছন্দ কেবিনে থেকে ৯০ থেকে ১ লাখের মধ্যে সিজারিয়ানের পর্ব শেষ করা। সিজারিয়ানের মূল খরচের একটি কনসালটেন্ট ফি, অন্যটি কেবিন ভাড়া। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, কনসালটেন্টরা তাদের চার্জ বেশি রাখায় কমছে না সিজারিয়ানের খরচ, উল্টো বক্তব্য সার্জনদের।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘কনসালটেন্টরা সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। সার্জনরা যদি টাকা কমিয়ে নেন তাহলে চার্জ অবশ্যই কম আসবে।’

ওজিএসবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের চার্জ হাসপাতালে বেড়েই চলছে এটার জন্য কোনো হাসপাতালের জবাবদিহিতা নেই। যে যার মতো বাড়িয়ে নিচ্ছে।’

ঢাকায় সার্জনের টিম চার্জ ১৫ হাজার থেকে ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর কেবিন ভাড়া ২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ঢাকা শহরে একটি মানসম্পন্ন সিজারিয়ানের জন্য সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়া উচিত নয়।

ওজিএসবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, ‘আমরা মনে হয় একেবারে উচ্চবিত্ত সার্জন এইটা করে সেখানেও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত না।’

যোগ্যতা অনুযায়ী কোন কনসালটেন্টের ফি কত হবে বা কোন হাসপাতালের ফি কেমন হবে সেটি নির্ধারণ করেন স্বয়ং কনসালটেন্ট বা সেই হাসপাতাল। এমনকি কোন হাসপাতাল কোন গ্রেডের সেটিও নির্ধারণ করা হয়নি আজও। জনগণ কেবল তার সাধ্য অনুযায়ী হাসপাতালে যেয়ে সেবা গ্রহণ করছে। সেখানে তার সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টিতে চিকিৎসক, হাসপাতাল এমনকি স্বাস্থ্য বিভাগেরও কোন যায় আসে না।

বরিশালের দুর্গম চরের অন্ত:স্বত্ত্বা আসমা বেগম। গর্ভে থাকা ৭ মাসের সন্তানকে নিয়ে রওনা হয়েছেন। গন্তব্য ৪ কিলোমিটার দূরের শায়েস্তাবাদ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গ্রামের এবড়ো থেবড়ো পথ পাড়ি দিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেই হয় চরাঞ্চলের মায়েদের। কিন্তু একবার ভাবুন, প্রসব ব্যথা ওঠার অর্নিধারিত সময়ে এই পথে মাকে দূরের হাসপাতালে নেয়া কতটা বিপদজনক?

তিনি বলেন, ‘চলাচলের রাস্তা ভালো না। ভাঙ্গা থাকে পরে আমি হেঁটে যায়। অনেক সমস্যা হয়। রাস্তা ভালো থাকলে অনেক সুবিধা হতো।’

তবে বরিশাল শহরে রয়েছে স্বাভাবিক ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের ভালো সুযোগ। তবে সিজারিয়ানের জন্য রোগীদেরকে গুণতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদিও চিকিৎসকদের দাবি, মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজারেই সম্পন্ন হচ্ছে একেকটি সিজারিয়ান।

বরিশাল মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. হাওয়া আক্তার জাহান বলেন, ‘কোনো জটিলতা না থাকলে মেডিসিনের খরচ সবারই একইরকম হয়ে থাকে। ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়া হয়ে থাকে। যদি নরমাল বেডে থাকে তাহলে ২০ হাজারে মধ্যে হয়ে যায় আর কেবিনে থাকলে কেবিন চার্জ অনুযায়ী।’

একজন বাবা বলেন, ‘পুরা জার্নিতে ১ লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে গিয়েছে সেখানে সিজার বাবদ ৩০ থেকে ৩৫ হাজারের মতো শেষ।’

নৈস্বর্গিক পাহাড়ী অঞ্চল চোখের দেখায় মুগ্ধতা ছড়ালেও গর্ভবতী মায়েদের জন্য কেবলই অনিশ্চয়তার অথৈ সাগর। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা বান্দরবানে প্রায় ৪ লাখ মানুষের বসবাস। অথচ ২০২৩ সাল জুড়ে মাত্র ১৭শ’ মা প্রসব করাতে আসতে পেরেছেন হাসপাতালে। এদের মধ্যে সিজারিয়ানে যেতে হয়েছে মাত্র ৩১৫ জনকে। বাকিরা কোথায় কিভাবে প্রসব করিয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। তবে বিভিন্ন তথ্য বলছে, দুর্গম এলাকার মায়েদের নাগালে স্বাভাবিক প্রসবের সুযোগটিও না থাকায় কবিরাজী ও বনেজি চিকিৎসার ওপরেই নির্ভর করেন তারা।

একজন বলেন, ‘অনেক গহীন থেকে কষ্ট করে নৌকায় করে হাসপাতালে এসেছি।’

বান্দরবান সদর হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চিংম্রা সাং মার্মা বলেন, ‘রেগুলার চেকাপ করাতে হবে গর্ভকালীন সময়ে এটাই অনেকে জানে না।’

বান্দরবানে কেবল সদর হাসপাতালেই রয়েছে সিজারিয়ানের সুযোগ। চিকিৎসকরা বলছেন, একটি নিরাপদ প্রসবের জন্য মায়েদের দরকারী তথ্যও পৌছানো সম্ভব হয় না দুর্গম এলাকায়। এরপরও যারা হাসপাতালে আসেন তাদের একটি অংশ শেষ সময়ে জটিল সমস্যা হাজির হন। পাহাড়ি এলাকায় আইসিইউ বা এনআইসিইউ না থাকায় এসব রোগীদের পাঠাতে হয় চট্টগ্রাম হাসপাতালে। যেটি ঐ সময় ভূক্তভোগীদের জন্য শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক যন্ত্রণা টেনে আনে।

বান্দরবান সদর হাসপাতালের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের গাইনি ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুল মনির রিবন বলেন, ‘যারা দুর্গম এলাকা থেকে আসে তারা সহজে সেবা নিতে আসে না। খুব খারাপ অবস্থায় এখানে আসে।’

রোগীদের সামর্থ্য না থাকায় এখানে বেসরকারি পর্যায়েও ভালো মানের সিজারিয়ানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। দুটি বেসরকারি হাসপাতালে ১ বছরে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে প্রায় ২০০টি আর সিজারিয়ান হয়েছে শতাধিক এবং সিজারিয়ানে একেকজন মায়ের খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

এবার আসা যাক, রাজধানী ঢাকায়। এখানে রয়েছে স্বাভাবিক প্রসব ও সিজারিয়ানের সর্বোচ্চ সুযোগ। মূলত সারাদেশের জটিল রোগীরা রেফার হয়ে আসেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। তবে রোগীদের স্রোতের কারণে সেবার পাশাপাশি বাণিজ্যের বলিও হন মায়েরা।

রাজধানীর হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতালে রোগীরা সন্তুষ্ট চিত্তে প্রসব করাতে পারেন। এর একটি রাজধানীর মোহাম্মদ ফার্টিলিটি সেন্টার। সরকারি এই হাসপাতালে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যেই স্বাভাবিক প্রসব এবং ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যেই সিজারিয়ান করে বাড়ি ফেরা সম্ভব। আশার খবর হলো প্রতিটি অন্ত:স্বত্ত্বাকেই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে না পারলে সিজারিয়ানের জন্য অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হয়। এ কারণে রোগীদের বেশিরভাগই সেবা ও খরচ নিয়ে সন্তুষ্ট।

একজন মা বলেন, ‘খরচ ৩ হাজারে মতো এইরকম হবে। প্রথমে নরমালে চেষ্টা করা হয়েছে সেখানে হয়নি পরে সিজারে নিয়ে যাওয়া হইছে।’

তবে এই সেবাটি ধরে রাখতে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফদের নিয়মিত নিবিড় প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় একটি মানসম্পন্ন টিম গড়ে ওঠায় রোগীদের জায়গা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে এই হাসপাতালে।

মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টারে সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সুচিত্রা সাহা বলেন, ‘একাডেমিক সেশনে কেউ নরমাল ডেলিভারি চাইলো কিন্তু সিজার হলো। কেন সিজার হলো সেখানে আমাদের কি ভুল ছিল তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।’

একইভাবে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৫ বছরের চেষ্টায় সিজারিয়ানের হার ৭০ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। লেবার অবজারভেশন, ইনডাকশান ও ডেলিভারির পৃথক রুমে সর্বোচ্চ মানের সেবার পরও স্বাভাবিক প্রসবে ১০ থেকে ১২ হাজার ও সিজারিয়ানে নেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা।

নিউজটি শেয়ার করুন

দেশে ৮৪ শতাংশই সিজারিয়ান বেসরকারিতে

আপডেট সময় : ০১:৫১:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪

হাসপাতালে প্রসবের হার বাড়ায় মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কিছুটা কমলেও ব্যাপকভাবে বেড়েছে সিজারিয়ান। খরচও গেছে নাগালের বাইরে। ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় সম্পন্ন হওয়া সিজারিয়ানের খরচ কোথাও কোথাও ২ লাখও ছুঁয়েছে। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান মায়ের শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি বাড়ালেও এর দায় নিচ্ছেন না কেউ। ১১ বছরে সিজারিয়ানের হার দ্বিগুণ হয়ে ৪৫ শতাংশে ঠেকেছে। যার ৮৪ শতাংশই বেসরকারিতে। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, শিগগিরই ৯০ শতাংশ ছাড়াবে।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০২২ এর তথ্য বলছে, ১১ বছরে সিজারিয়ানের হার দ্বিগুণ হয়ে ৪৫ শতাংশে ঠেকেছে। যেগুলোর ৮৪ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, রোগীদের স্বাভাবিক প্রসবে উদ্বুদ্ধ বা সহযোগীতা না করায় বেসরকারিতে সিজারিয়ানের হার শিগগিরই ৯০ শতাংশ ছাড়াবে।

ওজিএসবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘প্রত্যেকটা অপারেশনে জটিলতা রয়েছে। সিজারের কারণে অনেক রক্তক্ষরণ হতে পারে যার ফলে রোগী মারা যেতে পারে। আমাদের আরও অনেক সোচ্চার হওয়া উচিত যেন সিজারের হার কমিয়ে আনা যায়।’

তবে দেশের ইতিহাসে সিজারিয়ানের মাত্রা সর্বোচ্চ হবার দায় গাইনি পেশাজীবীদের সংগঠন ওজিএসবির ওপর চাপালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।

তিনি বলেন, ‘দুর্গম অঞ্চলে সিজারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে কেন সিজার হচ্ছে না। কিন্তু দেশে বেসরকারি সেক্টরে সিজারিয়ানের মাত্রা সর্বোচ্চ তা গাইনি পেশাজীবীদের সংগঠন ওজিএসবি উত্তর দিতে পারবে কেন এত বেশি।’

ঢাকায় হাসপাতালভেদে সিজারিয়ানের খরচ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যদিও অধিকাংশ মানুষের পছন্দ কেবিনে থেকে ৯০ থেকে ১ লাখের মধ্যে সিজারিয়ানের পর্ব শেষ করা। সিজারিয়ানের মূল খরচের একটি কনসালটেন্ট ফি, অন্যটি কেবিন ভাড়া। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, কনসালটেন্টরা তাদের চার্জ বেশি রাখায় কমছে না সিজারিয়ানের খরচ, উল্টো বক্তব্য সার্জনদের।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘কনসালটেন্টরা সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। সার্জনরা যদি টাকা কমিয়ে নেন তাহলে চার্জ অবশ্যই কম আসবে।’

ওজিএসবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের চার্জ হাসপাতালে বেড়েই চলছে এটার জন্য কোনো হাসপাতালের জবাবদিহিতা নেই। যে যার মতো বাড়িয়ে নিচ্ছে।’

ঢাকায় সার্জনের টিম চার্জ ১৫ হাজার থেকে ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর কেবিন ভাড়া ২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ঢাকা শহরে একটি মানসম্পন্ন সিজারিয়ানের জন্য সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়া উচিত নয়।

ওজিএসবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, ‘আমরা মনে হয় একেবারে উচ্চবিত্ত সার্জন এইটা করে সেখানেও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত না।’

যোগ্যতা অনুযায়ী কোন কনসালটেন্টের ফি কত হবে বা কোন হাসপাতালের ফি কেমন হবে সেটি নির্ধারণ করেন স্বয়ং কনসালটেন্ট বা সেই হাসপাতাল। এমনকি কোন হাসপাতাল কোন গ্রেডের সেটিও নির্ধারণ করা হয়নি আজও। জনগণ কেবল তার সাধ্য অনুযায়ী হাসপাতালে যেয়ে সেবা গ্রহণ করছে। সেখানে তার সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টিতে চিকিৎসক, হাসপাতাল এমনকি স্বাস্থ্য বিভাগেরও কোন যায় আসে না।

বরিশালের দুর্গম চরের অন্ত:স্বত্ত্বা আসমা বেগম। গর্ভে থাকা ৭ মাসের সন্তানকে নিয়ে রওনা হয়েছেন। গন্তব্য ৪ কিলোমিটার দূরের শায়েস্তাবাদ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গ্রামের এবড়ো থেবড়ো পথ পাড়ি দিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেই হয় চরাঞ্চলের মায়েদের। কিন্তু একবার ভাবুন, প্রসব ব্যথা ওঠার অর্নিধারিত সময়ে এই পথে মাকে দূরের হাসপাতালে নেয়া কতটা বিপদজনক?

তিনি বলেন, ‘চলাচলের রাস্তা ভালো না। ভাঙ্গা থাকে পরে আমি হেঁটে যায়। অনেক সমস্যা হয়। রাস্তা ভালো থাকলে অনেক সুবিধা হতো।’

তবে বরিশাল শহরে রয়েছে স্বাভাবিক ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের ভালো সুযোগ। তবে সিজারিয়ানের জন্য রোগীদেরকে গুণতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদিও চিকিৎসকদের দাবি, মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজারেই সম্পন্ন হচ্ছে একেকটি সিজারিয়ান।

বরিশাল মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. হাওয়া আক্তার জাহান বলেন, ‘কোনো জটিলতা না থাকলে মেডিসিনের খরচ সবারই একইরকম হয়ে থাকে। ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়া হয়ে থাকে। যদি নরমাল বেডে থাকে তাহলে ২০ হাজারে মধ্যে হয়ে যায় আর কেবিনে থাকলে কেবিন চার্জ অনুযায়ী।’

একজন বাবা বলেন, ‘পুরা জার্নিতে ১ লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে গিয়েছে সেখানে সিজার বাবদ ৩০ থেকে ৩৫ হাজারের মতো শেষ।’

নৈস্বর্গিক পাহাড়ী অঞ্চল চোখের দেখায় মুগ্ধতা ছড়ালেও গর্ভবতী মায়েদের জন্য কেবলই অনিশ্চয়তার অথৈ সাগর। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা বান্দরবানে প্রায় ৪ লাখ মানুষের বসবাস। অথচ ২০২৩ সাল জুড়ে মাত্র ১৭শ’ মা প্রসব করাতে আসতে পেরেছেন হাসপাতালে। এদের মধ্যে সিজারিয়ানে যেতে হয়েছে মাত্র ৩১৫ জনকে। বাকিরা কোথায় কিভাবে প্রসব করিয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। তবে বিভিন্ন তথ্য বলছে, দুর্গম এলাকার মায়েদের নাগালে স্বাভাবিক প্রসবের সুযোগটিও না থাকায় কবিরাজী ও বনেজি চিকিৎসার ওপরেই নির্ভর করেন তারা।

একজন বলেন, ‘অনেক গহীন থেকে কষ্ট করে নৌকায় করে হাসপাতালে এসেছি।’

বান্দরবান সদর হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চিংম্রা সাং মার্মা বলেন, ‘রেগুলার চেকাপ করাতে হবে গর্ভকালীন সময়ে এটাই অনেকে জানে না।’

বান্দরবানে কেবল সদর হাসপাতালেই রয়েছে সিজারিয়ানের সুযোগ। চিকিৎসকরা বলছেন, একটি নিরাপদ প্রসবের জন্য মায়েদের দরকারী তথ্যও পৌছানো সম্ভব হয় না দুর্গম এলাকায়। এরপরও যারা হাসপাতালে আসেন তাদের একটি অংশ শেষ সময়ে জটিল সমস্যা হাজির হন। পাহাড়ি এলাকায় আইসিইউ বা এনআইসিইউ না থাকায় এসব রোগীদের পাঠাতে হয় চট্টগ্রাম হাসপাতালে। যেটি ঐ সময় ভূক্তভোগীদের জন্য শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক যন্ত্রণা টেনে আনে।

বান্দরবান সদর হাসপাতালের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের গাইনি ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুল মনির রিবন বলেন, ‘যারা দুর্গম এলাকা থেকে আসে তারা সহজে সেবা নিতে আসে না। খুব খারাপ অবস্থায় এখানে আসে।’

রোগীদের সামর্থ্য না থাকায় এখানে বেসরকারি পর্যায়েও ভালো মানের সিজারিয়ানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। দুটি বেসরকারি হাসপাতালে ১ বছরে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে প্রায় ২০০টি আর সিজারিয়ান হয়েছে শতাধিক এবং সিজারিয়ানে একেকজন মায়ের খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

এবার আসা যাক, রাজধানী ঢাকায়। এখানে রয়েছে স্বাভাবিক প্রসব ও সিজারিয়ানের সর্বোচ্চ সুযোগ। মূলত সারাদেশের জটিল রোগীরা রেফার হয়ে আসেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। তবে রোগীদের স্রোতের কারণে সেবার পাশাপাশি বাণিজ্যের বলিও হন মায়েরা।

রাজধানীর হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতালে রোগীরা সন্তুষ্ট চিত্তে প্রসব করাতে পারেন। এর একটি রাজধানীর মোহাম্মদ ফার্টিলিটি সেন্টার। সরকারি এই হাসপাতালে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যেই স্বাভাবিক প্রসব এবং ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যেই সিজারিয়ান করে বাড়ি ফেরা সম্ভব। আশার খবর হলো প্রতিটি অন্ত:স্বত্ত্বাকেই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে না পারলে সিজারিয়ানের জন্য অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হয়। এ কারণে রোগীদের বেশিরভাগই সেবা ও খরচ নিয়ে সন্তুষ্ট।

একজন মা বলেন, ‘খরচ ৩ হাজারে মতো এইরকম হবে। প্রথমে নরমালে চেষ্টা করা হয়েছে সেখানে হয়নি পরে সিজারে নিয়ে যাওয়া হইছে।’

তবে এই সেবাটি ধরে রাখতে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফদের নিয়মিত নিবিড় প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় একটি মানসম্পন্ন টিম গড়ে ওঠায় রোগীদের জায়গা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে এই হাসপাতালে।

মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টারে সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সুচিত্রা সাহা বলেন, ‘একাডেমিক সেশনে কেউ নরমাল ডেলিভারি চাইলো কিন্তু সিজার হলো। কেন সিজার হলো সেখানে আমাদের কি ভুল ছিল তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।’

একইভাবে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৫ বছরের চেষ্টায় সিজারিয়ানের হার ৭০ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। লেবার অবজারভেশন, ইনডাকশান ও ডেলিভারির পৃথক রুমে সর্বোচ্চ মানের সেবার পরও স্বাভাবিক প্রসবে ১০ থেকে ১২ হাজার ও সিজারিয়ানে নেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা।