ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও মেঘনার উজানে বন্যা দীর্ঘ হয়ে থাকতে পারে জুলাই-আগস্টেও। বন্যা ব্যবস্থাপনা গবেষকরা বলছেন, ১০ বছরে এই দুই অববাহিকায় বন্যার প্রবণতা বেড়েছে। এ বছরও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার ভোগান্তি থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রও। জুলাইয়ের শেষে তিস্তার তীরেও হতে পারে বন্যা।
এদিকে, বর্তমানে বন্যার কারণে দেশের ১৫টি জেলায় এখন পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করছেন ১৮ লাখ ৭৬ হাজার নয়শ' ৫৬ জন মানুষ। এ তথ্য জানিয়েছেন দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান।
সাম্প্রতিক উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাথে মতবিনিময়ের আগে তিনি এ কথা জানান।
প্রতিমন্ত্রী এ সময় আরও জানান, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। বন্যা কবলিত এলাকায় এ পর্যন্ত তিন কোটি ১০ লাখ টাকার নগদ সহায়তা, ৮৭০০ টন চালসহ অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
এ সময় দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ খাদ্য সংকটে আছে - গণমাধ্যমে প্রচারিত এমন সংবাদ সঠিক নয়। শিগগিরই তিনি দূর্যোগ আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন বলেও জানান মহিববুর রহমান।
এদিকে, যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার নিয়েছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে গত ২৪ ঘন্টায় যমুনার পানি আরও ১ সে.মি বেড়ে আজ (শনিবার) সকালে বিপদসীমার ৯৩ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
যমুনার প্রবল স্রোতে জেলার ৬ উপজেলার বিভিন্ন সড়কের উপড় দিয়ে হু-হু করে জনপদে পানি ঢুকছে এবং নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ইসলামপুর ছাড়াও দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার নতুন করে বিভিন্ন এলাকা বন্যা প্লাবিত হয়েছে।
যমুনা ছাড়াও ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই, জিঞ্জিরাম, দশানীসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সব মিলিয়ে জেলার ৬টি উপজেলার প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকায় খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে দুর্গতরা। বাড়ি-ঘরে পানি উঠায় অনেকে সড়ক, বাঁধ ও স্কুলের উচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নিতে গিয়েও বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষের গরু ছাগল হাস মুরগী পানির শ্রোতে ভেসে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে জেলায় ৮ হাজার ৮৭২ হেক্টর রোপা আমনসহ জমির বিভিন্ন ফসল এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় সরকারিভাবে যে খাদ্য দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।
উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারিবর্ষণে গাইবান্ধার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ১ সেন্টিমিটার কমে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অপরদিকে ঘাঘট নদীর পানি শহরের নতুন ব্রীজ পয়েন্টে বিপদসীমা ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ২৮ ইউনিয়নের ৫০ হাজার পরিবার গেল চার দিন থেকে পানিবন্দী হয়ে আছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট। বন্যা এলাকায় শুরু হয়নি তেমন তৎপরতা। বাধ্য হয়ে সহায় সম্বল নিয়ে নিরাপদ স্থানে ছুটছেন বন্যা কবলিত এসব মানুষ।
কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। ২য় দফা বন্যায় মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা, মনু ও জুড়ী নদীর পানি ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাকালুকি হাওর তীরবর্তী রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা উপজেলায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় পানিবন্দি মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
কমলগঞ্জের খরস্রোতা ধলাই নদীতে ব্যাপক আকারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীতে পানি বৃদ্ধি ও কমে যাওয়ার পর নদী তীরবর্তী বেশ কিছু গ্রাম ও বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পুরো নদীর ৬০ কিলোমিটার বাঁধ নদীতে মিশে যাওয়াতে পৌরসভা এবং ইসলামপুর, মাধবপুর, কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, মুন্সীবাজার ও রহিমপুর ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা হুমকির মুখে পড়ছে।
কুলাউড়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার চারটি ওয়ার্ডের ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সড়ক পানিতে ডুবে আছে। আটাশটি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ২ হাজার ৬৩ ও উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এখানকার মানুষের বাসাবাড়িসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ডুবে আছে।
কয়েক দফা বন্যায় বিপর্যস্ত উত্তরপূর্বের মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা। পানিবন্দি প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এ বছর লানিনার প্রভাবে অতিভারী বৃষ্টি হচ্ছে চেরাপুঞ্জিতে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্প হিমালয়ে বাধা পেয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। সেজন্য উজানের ঢলে অসময়ে বন্যা সিলেটে। গবেষকরা বলছেন, জুলাইয়ের শেষে বন্যা আরও তীব্র হতে পারে।
বন্যা ও বাঁধ গবেষক আমীর হোসাইন বলেন, ‘চলতি মাসের তৃতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে ফের বন্যার শঙ্কা রয়েছে। ওই এলাকার জন্য অবশ্যই এটা আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি। ক্ষতির পরিমাণটাও জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকবে। সেক্ষেত্রে আগস্টের পরিস্থিতি কেমন হয় তা নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
উত্তরপূর্বের হাওর একমাত্র এলাকা যেখানে তিন দিক দিয়ে পানি ঢোকে। হিমালয়ের উজানের পানি উত্তর থেকে দক্ষিণে নামে। বরাকের পানি পূর্ব থেকে পশ্চিমে সুরমা হয়ে আসে। আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত হয়ে কুশিয়ারার পানি আসে হবিগঞ্জ–মৌলভীবাজারে। এসব পানি মেঘনায় মেশার একমাত্র পথ খালিয়াজুড়ি ও ভৈরব বাজার। তবে ভাটিতে নানা বাধায় বন্যা তীব্র হচ্ছে।
আমীর হোসাইন বলেন, ‘অনেকগুলো রাস্তাই পানির প্রবাহকে বাধা দেয়। পানির প্রবাহ যেদিকে তার আড়াআড়িভাবে রাস্তাগুলো বানানো হয়েছে। এ কারণে পানি মূলত ওইখানে আটকে থাকছে।’
একই সময়ে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় দেখা দিয়েছে বন্যা। কয়েকদিনে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলের ১১ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে বইছে। তবে পদ্মার পানি এখনও বিপৎসীমার নিচে থাকায় বড় বন্যার শঙ্কা কম।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. তরিকুল ইসলাম বলেন, যেহেতু ভারতে বৃষ্টি হচ্ছে, সেহেতু ব্রহ্মপুত্রে বন্যা পরিস্থিতি হতে পারে। ব্রহ্মপুত্রে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ভারী বৃষ্টিতে কয়েক দিন তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার তীরের নিম্নাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।