এক নজরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যা যা ঘটল
- আপডেট সময় : ০৮:১৯:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪
- / ৩৭১ বার পড়া হয়েছে
কোটা সংস্কার চেয়ে জুলাইজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনকারীরা। তবে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘিরে দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে একপর্যায়ে কারফিউ জারি করে সরকার। সেই সঙ্গে নামানো হয় সেনাবাহিনী। ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি।
আজ বুধবার (২৪ জুলাই) কারফিউ শিথিল করে সরকারি-বেসরকারি অফিস চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেয়া হয়। এতে গত কয়েকদিনের বন্দিদশা থেকে বের হয়ে কাজে যোগ দিতে পারায় জনমনে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) ও ২১টি জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়- গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে নাশকতার অভিযোগে ৮০০ এর বেশি গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব।
গত ১০ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো-
কোটা সংস্কার নিয়ে ১ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। পরে ৬ জুলাই আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা চার ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। এরপর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পরদিন (৭ জুলাই) সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেড নামে অবরোধ কর্মসূচির পালন করার ঘোষণা দেয়া হয়।
১০ই জুলাই, বুধবার
কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের আদেশের ওপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা, ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য।
শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, আমরা এই সমাজের মানুষ, কিছু কথা বলতেই হয়। সেটি হচ্ছে যে একটা রায় হাইকোর্টে হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছে। সেখানে তারা যেটা করেছে, এটা অ্যাপ্রিশিয়েট (প্রশংসা) করার মতো না। মনে হয়, তারা ভুল বুঝেই করেছে। যা-ই হোক যেটিই করেছে, তারা আমাদেরই ছেলে-মেয়ে।
১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার
ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি।
এদিকে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন।
১২ জুলাই, শুক্রবার
শুক্রবার ছুটির দিনে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। রেলপথ অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
১৩ জুলাই, শনিবার
সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। রোববার (১৪ জুলাই) গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর এ স্মারকলিপি দেবেন আন্দোলনকারীরা।
১৪ জুলাই, রোববার
কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এছাড়া এদিন চীন সফর নিয়ে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না।
এদিকে রোববার রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-মিছিল করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। সেদিন জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও মিছিল হয়েছে।
১৫ই জুলাই, সোমবার
এদিন বেলা তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আন্দোলনকারীদের মারধর করা হয়। গুলি করতেও দেখা যায়।
এর আগে বেলা দুইটায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের রাজাকার স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আন্দোলন থেকে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বা আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। এর জবাব দেয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।
১৬ই জুলাই, মঙ্গলবার
আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের। সড়ক অবরোধ, সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা, ছয়জন নিহত। এর মধ্যে রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার সচিত্র ছবি প্রকাশ পায়। এছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নতুন কর্মসূচি দেয়া হয়। নিহতদের স্মরণে বুধবার (১৭ জুলাই) গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করবেন তারা।
১৭ই জুলাই, বুধবার
বুধবার ছুটির দিনে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষম, ধাওয়া ও পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কফিন মিছিল পণ্ড হয়ে যায়।
পরে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন।
এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।
এছাড়া এই আন্দোলন ঘিরে নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন সরকারপ্রধান।
১৮ই জুলাই, বৃহস্পতিবার:
-কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
-বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
-মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ থাকে, পরে হেলিকপ্টারে তাদের উদ্ধার করা হয়।
-পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ বিক্ষোভকারীরা আহত হয়।
– আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।
-আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
-রাত ৯টা থেকে ইন্টারনেট সংযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়।
-সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
১৯শে জুলাই, শুক্রবার
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল, পরিস্থিতি ছিল থমথমে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
আন্দোলনকারীরা জানান, ৯ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত চলবে কমপ্লিট শাটডাউন। এরপর রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
২০ জুলাই, শনিবার
কারফিউর মধ্যেও ঢাকা, সাভার, গাজীপুর ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিহতর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া সংঘর্ষে আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। এদিন পরিস্থিতি খারাপ থাকায় রোববার এবং সোমবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেয়ার অভিযোগ।
এছাড়া তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আট দফা দাবি পেশ করেন আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক। শুক্রবার সরকারি তিন স্থাপনায় আগুনে ১১৩ যানবাহন পুড়ে ছাই হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এছাড়া কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ নম্বর মেট্রো স্টেশনে বিপুল ক্ষতি হয়।
২১শে জুলাই, রোববার
কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের শুনানি, কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ নির্ধারণের আদেশ দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে এ রায় দেন। রায়ে বলা হয়, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল ও সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।
কারফিউ অব্যাহত, সাধারণ ছুটির আওতায় স্বায়ত্বশাসিত, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
২২শে জুলাই, সোমবার
কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এই সময়ের মধ্যে তারা চার দফা দাবির বাস্তবায়ন দেখার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছেন। সাধারণ ছুটির মেয়াদ মঙ্গলবার পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। কারফিউও বাড়ানো হয়েছে এদিন।
২৩ জুলাই, মঙ্গলবার
কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এছাড়া মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে অনেকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। মৃত্যুর এই খবর কিছু হাসপাতাল, মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের সূত্রে পাওয়া যায়।