মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার কর্মীরা। আইনি প্রক্রিয়া মেনেই দলটিকে নিষিদ্ধ করার তাগিদ দিয়ে তাঁরা বলছেন, হাইকোর্ট থেকে ঘোষিত সন্ত্রাসী দলটি কোনোভাবেই যেন রাজনীতিতে না থাকতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন আদালত। সবশেষ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আদালতের আদেশে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল বহাল রাখে নির্বাচন কমিশন। এর আগে বিচার বিভাগের প্রতীকের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৭ সালের মার্চে জামায়াতের নির্বাচনী মার্কা দাঁড়িপাল্লা প্রতীকও বাতিল করে ইসি।
অবশেষে জামাতকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বুধবারের মধ্যেই নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হচ্ছে।
রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা বলছেন, বরাবরই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দলটি। বারবার তারা সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-হত্যাকাণ্ডে দেশকে অকার্যকর করতে চেয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এতদিন কেন এদেরকে (জামায়াত-শিবির) নিরোধ করা হলো না? যেখানে আদালত বলছেন সন্ত্রাসী সংগঠন, যেখানে নির্বাচন কমিশন থেকে এর নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, বহু আগে তো আদর্শিক কারণে, নৈতিক কারণে, বাস্তব কারণে এই দলকে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। বিগত অন্তত ৪০ বছর ধরে বলে আসছি এই জামায়াতে ইসলামীর স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নাই।’
সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মানবাধিকার কর্মীর বলছেন, অনেক আগেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। এর মাধ্যমে জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো।
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বলেন, ‘ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র থাকলে এখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকা উচিত না। আর জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে আমাদের খুব স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে তারা যুদ্ধাপরাধী। আর যুদ্ধাপরাধীদের জায়গা এইখানে নাই।’
নিষিদ্ধ হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা দেশে যাতে নাশকতা চালাতে না পারে সে বিষয়ে সরকারকে যথেষ্ট সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত–শিবিরকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে বৈঠকের সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এর প্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, জামায়াত–শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে বুধবারের মধ্যে নির্বাহী আদেশ জারি করা হতে পারে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। আর শিবিরের আগের নাম ছিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘ। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের পূর্ব লগ্নে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার জন্য এই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের সরাসরি দায়ী করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় দলটির সাবেক বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে। অনেকের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়েছে।
১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত–শিবির নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত–শিবির নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা কারণে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক নানা পট পরিবর্তনের পর দেশের রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হয় জামায়াত।
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠন করলে দলটির কয়েকজন নেতা মন্ত্রিসভায়ও স্থান পান। যা নিয়ে সে সময় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।
এদিকে সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যে পর্যায়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এর জন্য সরকার জামায়াত ও শিবিরকেই দায়ী করছে। এই সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু হতাহত হন। সরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ১৫০ আর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, দেশজুড়ে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২৬৬ জন।
সরকারের দাবি, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াত–শিবিরের নেতাকর্মীরা ছদ্মবেশে প্রবেশ করে সহিংসতা উসকে দেয়। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভি, বনানীর সেতুভবন, মহাখালির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, মেট্রোরেল স্টেশনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায়।