শরণার্থী থেকে যেভাবে হামাসের শীর্ষ নেতা হানিয়া
- আপডেট সময় : ০১:২১:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ জুলাই ২০২৪
- / ৩৭৪ বার পড়া হয়েছে
অগ্নিগর্ভ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ও কুটিল রাজনীতিতে ইসমাইল হানিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আজ বুধবার ইরানে এক হামলায় নিহত হয়েছেন ইসমাইল হানিয়া। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড (আইআরজিসি) তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করার পাশাপাশি হামাসও তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হানিয়া তেহরানে গিয়েছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন পেজেশকিয়ান। হামাস তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘তেহরানে বিশ্বাসঘাতক ইহুদিবাদীদের অভিযানে’ নিহত হয়েছেন ইসমাইল হানিয়া।
ইসমাইল হানিয়ার শৈশব
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার শাতি শরণার্থী শিবিরে ১৯৬২ সালের ২৯ জানুয়ারি জন্ম ইসমাইল হানিয়ার। গত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকা এই গাজাতেই বেড়ে ওঠেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁর বেড়ে ওঠার পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বহু কাঁটা বিছানো পথ মাড়িয়ে তিনি এক সময় হামাসের শীর্ষ নেতায় পরিণত হয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন
ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট (ইউএনআরডব্লিউএ) পরিচালিত একটি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল ইসমাইল হানিয়ার। পরে তিনি গাজার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সাহিত্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ওই সময়েই তিনি জড়িয়ে পড়েন হামাসের সঙ্গে। একই সময়ে তাঁর সম্পর্ক ছিল মিশরভিত্তিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডে সঙ্গেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময় ইসমাইল হানিয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র পরিষদের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
হানিয়ার রাজনৈতিক জীবন
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের উত্থানের সময় থেকেই হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন ইসমাইল হানিয়া। ১৯৮০–এর দশকের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হামাসের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি দখলদারিত্ব প্রতিহত করা এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। গত শতকের ৯০–এর দশকের শুরু থেকেই হামাসের নানা কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন ইসমাইল হানিয়া। এরপর ক্রমশ তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বগুণে হামাসের শীর্ষ নেতা হয়ে ওঠেন। ২০১৭ সালে তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন। আর ২০২১ সাল থেকে হামাসের প্রধানের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী হানিয়া
২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন ইসমাইল হানিয়া। পরে হামাস ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন ফাতাহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হলে ২০০৭ সালে ফাতাহকে গাজা থেকে বিতাড়িত করা হয়। এর ফলে পশ্চিম তীর ও গাজা বিভক্ত হয়ে পড়ে। একই কারণে হামাস সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন হানিয়া। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁকে।
হানিয়াকে নিয়ে যত বিতর্ক
ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যথেষ্ঠ বিতর্ক হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বাধীন সময়েই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। গাজাকেও তিনি বেশ কয়েকবার চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ইসরায়েল ও মিশর গাজার ওপর অবরোধ দিয়েছে। ফলে গাজাবাসী যে সীমাহীন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছিল, তা দক্ষহাতে সামলাতে পারেননি ইসমাইল হানিয়া। এসব সংকট মোকাবিলার দিকে নজর না দিয়ে তিনি বরং বারবার ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে এবং গাজা কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
মধ্যস্থতা ও ফাতাহর সঙ্গে একীভূত হওয়ার চেষ্টা
গত কয়েক বছর ধরেই ফাতাহর সঙ্গে মধ্যস্থতা করে হামাস ও ফাতাহকে আবাও একীভূত করার চেষ্টা করছিলেন ইসমাইল হানিয়া। তিনি এই দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছিলেন। শেষ সময়ে এসে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, হামাম ও ফাতাহ এক সঙ্গে থাকলে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হবেন এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠাতা করা সহজ হবে। এই লক্ষ্যে ২০২১ সালে ফাতাহর সঙ্গে একটি ‘পুনর্মিলন চুক্তি’ স্বাক্ষরও করেছিলেন ইসমাইল হানিয়া।
যেখানে অনন্য ইসমাইল হানিয়া
ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিরোধ ও সংকল্পের দৃঢ় প্রতীক হয়ে আছেন ইসমাইল হানিয়া। ইসরায়েলের মতো অত্যাধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর অব্যাহত হামলার মধ্যেও হামাস এখন পর্যন্ত যে সাফল্য দেখিয়েছে, তার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয় ইসমাইল হানিয়াকে। তিনি প্রতিরোধযুদ্ধের পাশাপাশি ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টাও চালিয়ে গেছেন। এতে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই ফুঁটে ওঠে।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত কারাবন্দী ছিলেন ইসমাইল হানিয়া। এরপর লেবানন সীমান্তের শূন্যরেখায় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হানিয়াকে ছেড়ে দিলে তিনি এক বছর নির্বাসনে ছিলেন। পরে তিনি গাজায় ফিরেছিলেন। ৬২ বছরের জীবনে ইসমাইল হানিয়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে থেকে হামাস পরিচালনা করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিজ দেশের বাইরে এক সন্ত্রাসী হামলার মধ্যেই তিনি নিহত হলেন। তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, গার্ডিয়ান ও নিউ ইয়র্ক টাইমস