প্রথমে ছাত্র ও পরবর্তীতে গণ আন্দোলনের জেরে গত সোমবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘আয়নাঘর’ নামক কোনও স্থানের ভিতরের দৃশ্য দাবি করে একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছে। ১৪ সেকেন্ডের সেই ভিডিওটিতে একটি টানেল বা গুহা সদৃশ্য জায়গায় বহু নরকঙ্কাল ও হাড় পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “না জানি কত মায়ের সন্তান এখানে শেষ হয়েছে। আয়নাঘরের আন্ডারগ্রাউন্ড।” পাশাপাশি ভিডিওর ফ্রেমের উপরে লেখা হয়েছে, “শেখ হাসিনার আয়না ঘর” (সব বানান অপরিবর্তিত।) একই দাবি-সহ আরও পোস্ট দেখতে এখানে ক্লিক করুন। এমনই একটি পোস্টের আর্কাইভ এখানে দেখা যাবে।
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল ভিডিওটিতে ‘আয়নাঘর’ দাবি করে যে স্থানটিকে দেখানো হয়েছে সেটি আসলে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত ‘দ্য ক্যাটাকম্বস’-এর দৃশ্য।
https://www.tiktok.com/@achilles.bc/video/7381466055115377952
কীভাবে জানা গেল সত্য?
ভাইারল পোস্টের সত্যতা জানার আগে আমরা প্রথমে ‘আয়নাঘর’ আসলে কী সেই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করি। তখন এই সংক্রান্ত কিওয়ার্ড সার্চ করলে গত ৭ আগস্ট আমরা ইন্ডিয়া টুডের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আয়নাঘর’ বা ‘ হাউস অফ মিররস’ হল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সেনানিবাসে অবস্থিত রাজনৈতিক ও কুখ্যাত বন্দিদের আশ্রয়স্থল। এই আয়নাঘরের পরিচালনার দায়িত্বে আছে, বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা তথা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স। সংক্ষেপে যাকে বলা হয় ডিজিএফআই।
এরপর আমরা ভাইরাল ভিডিওর সত্যতা জানতে অর্থাৎ নরকঙ্কাল ভর্তি টানেল বা গুহাটি বাংলাদেশের ঢাকায় অবস্থিত বন্দিদের আশ্রয়স্থল আয়নাঘরের কিনা তা খোঁজার চেষ্টা করি। সেই উদ্দেশ্যে আমরা ভিডিও ক্লিপটি থেকে একাধিক স্ক্রিনশট নিয়ে সেগুলির রিভার্স ইমেজ সার্চ। তখন আমরা চলতি বছরের অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১৭ জুন ‘Achilles.bc’ নামক একটি টিকটক অ্যাকাউন্টে এই একই ভিডিওটি দেখতে পাই। ভিডিওটি শেয়ার করে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত একটি টানেল।
এরপর আমরা আমাদের সার্চের মাধ্যমে ‘দ্য ক্যাটাকম্বস অব প্যারিস’-এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের সন্ধান পাই। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে শিল্প বিপ্লবের কারণে ইউরোপের অন্যান্য শহরগুলির মতো ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের জনসংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আর এরই পাশাপাশি সেখানকার মানুষের বিভিন্ন রোগ এবং মৃত্যুর হারও ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই অনুপাতে সেখানকার কবরস্থানগুলোর স্থানসঙ্কটের কারণে মৃতদেহগুলো গাদাগাদি করে রাখা হত। আর এই মৃতদেহগুলির পচনের কারণে একদিকে যেমন শহরে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে অন্যদিকে সুস্থ মানুষের মধ্যেও রোগের সংক্রমণ দেখা দিতে থাকে।
এরপর আমরা history.com-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, তৎকালীন ফ্রান্স সরকার এই স্বাস্থ্য সংকট থেকে মুক্তি পেতে অর্থাৎ জীবিত মানুষকে পঁচা মৃতদেহ থেকে সৃষ্ট রোগ থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য মৃতদেহগুলি প্যারিস শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত পুরনো ও অব্যবহৃত চুনাপাথরের খনিগুলিতে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার পর থেকেই এই সব ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের অস্থি বা নরকঙ্কাল রাখা হয়েছিল।
এরপর আমরা আমাদের সার্চের মাধ্যমে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট সুইডেন-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে আয়নাঘরের আসল ছবি খুঁজে পাই। নেত্র নিউজের ছবিগুলিকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট ভয়েস অফ আমেরিকার তরফেও আয়নাঘর সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কিন্তু উভয় প্রতিবেদনের ছবিগুলির সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওর কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
https://x.com/Alphafox78/status/1803132823089389994