ঢাকা ০১:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

‘পরিবর্তন যদি না আসে মা, তাহলে কারো বেঁচে থেকে লাভ নেই’

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০১:০০:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৩৬৮ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বেঁচে থাকলে আরও দুইটা গুলি কর। গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে ড্রেন থেকে রিকশায় তোলার সময় বলছিলেন এক পুলিশ সদস্য। মুমূর্ষু নাফিজকে পাশের হাসপাতালে নেয়া হলে দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। চিকিৎসা পেলে হয়তো প্রাণে বাঁচতো, সেই আফসোসে দগ্ধ হচ্ছে নাফিজের পরিবার।

নাফিজ নয় যেন রিকশার পাদানিতে ঝুলছে এক টুকরো বাংলাদেশ। ১৭ বছরের নাফিজের বুলেটবিদ্ধ দেহ, রক্ত ঝরে ঝরে নিথর হলেও মাথা থেকে খসে পড়েনি বাংলাদেশের পতাকা।

৪ আগস্ট সকালে বাবার কাছে ৩০ টাকা চেয়েছিলো নাফিজ। বাবা ১০০ টাকা দিতে চাইলেও ৩০ টাকা নিয়েই বাড়ি ছেড়েছিলো। সে টাকা দিয়েই কিনেছিলো পতাকা। এই পতাকা দেখেই মর্গে অসংখ্য মরদেহের ভীড়ে ছেলেকে খুঁজে পেতে দেরি হয়নি বাবার।

গর্ব করে মা বলছিলেন, প্রতিবছর নতুন নতুন পতাকা বানিয়ে বাসার গ্রিলে লটকে দিতো নাফিজ।

নাফিজের মা নাজমা আক্তার বলেন, ‘ও ছোট থেকেই পতাকা খুব ভালোবাসতো। সবসময় স্বপ্ন ছিল দেশ নিয়ে। এ পতাকাগুলো আমি চাইতাম যে আর রাখার দরকার নেই। ও ফেলতে দিত না। কাল দেখি পতাকাগুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা।’

তিনি বলেন, ‘ইদানিং ও বলতো পরিবর্তন যদি না আসে মা, তাহলে আপনার নাফিজ না, কারো বেঁচে থেকে লাভ নেই। পরিবর্তন আনতেই হবে, নাহলে আমরা ঘরের ভেতরে বন্দি।’

বাবা মায়ের যন্ত্রণা, কেন আহত সন্তানকে হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হলো না? যারা ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের কি সন্তান নেই?

নাফিজের বাবা গোলাম রহমান লিটন বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হাসপাতালে নেয়া হলে আমার ছেলে অবশ্যই আল্লাহর রহমতে বেঁচে যেত। কিন্তু ছাত্রলীগ বা পুলিশের বাধার কারণে আমার ছেলেটা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মারা গেল।’

তিনি বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে মেধাবী ছেলেদের যেভাবে মারা হয়েছে সেটা খুবই দুঃখজনক।’

ড্রেনে পড়ে থাকা নাফিজের ক্ষতবিক্ষত দেহ কয়েকজন পুলিশ তুলে দিয়েছিলো এই রিকশায়। মৃত্যু নিশ্চিত না হলে আবারও গুলি চালানোর হুমকিও দিয়েছিলো।

শুরু থেকেই প্রতিটি দিন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো নাফিজ। টিয়ারশেল রাবার বুলেটের আঘাত পেয়েও দমে যায়নি। সবশেষ ৪ আগস্ট মোবাইল মানিব্যাগ সব রেখে ঘর ছেড়েছিলো। যেন শহীদ হবার প্রস্তুতি নিয়েই বেরিয়েছিলো নাফিজ, দাবি তার বড় ভায়ের।

বড় ভাই গোলাম রাসেল বলেন, ‘ওইদিন আসলে আমার ভাই শহীদ হতেই গিয়েছিল। ও ফোন, ওয়ালেট থেকে শুরু করে সব স্মৃতি আমাদের কাছে রেখে গেছে। ও আল্লাহর ডাকে, দেশের ডাকে চলে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘ও সবসময় আম্মুকে বলতো এইযে আবু সাঈদ ভাই, মুগ্ধ ভাই শহীদ হয়েছেন, তারা তো মারা যান নি অমর হয়ে গেছেন।’

নাফিজের মস্তিষ্কে বাংলাদেশ ছাড়া কিছুই ছিলো না। মেধাবীরা দেশ চালাতে না পারলে বদলাবে না বাংলাদেশ, এই ছিলো মাধ্যমিকে জিপিএ পাঁচ পাওয়া নাফিজের চিন্তায়। সেনা অফিসার হয়ে সে দায়িত্ব পালনের স্বপ্নও দেখেছিলো নৌ বাহিনী কলেজের প্রথম বর্ষের নাফিজ।

নাফিজের বাবা বলেন, ‘রিকশায় নাফিজের লাশ তুলে দেয়ার পর চালককেও বকা দেয়া হয়েছে। এরপর তাকে বলা হয়, লাশটা নিয়ে যা, হাসপাতালে যাচ্ছিস কেনো। চালককেও গুলি করে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। তখন এক পুলিশ অফিসার নাকি জিজ্ঞাসা করেছে মরে নাই? মরছে, তাহলে আরো দুইটা গুলি কর।’

বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে নিহত হওয়া নাফিজের বাবার ইচ্ছা, বাংলাদেশ যেন নাফিজের মতো শত শহীদকে ভুলে না যায়। বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের স্বপ্নগুলো যেন পূরণ করে তার উত্তরসূরীরা।

নিউজটি শেয়ার করুন

‘পরিবর্তন যদি না আসে মা, তাহলে কারো বেঁচে থেকে লাভ নেই’

আপডেট সময় : ০১:০০:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪

বেঁচে থাকলে আরও দুইটা গুলি কর। গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে ড্রেন থেকে রিকশায় তোলার সময় বলছিলেন এক পুলিশ সদস্য। মুমূর্ষু নাফিজকে পাশের হাসপাতালে নেয়া হলে দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। চিকিৎসা পেলে হয়তো প্রাণে বাঁচতো, সেই আফসোসে দগ্ধ হচ্ছে নাফিজের পরিবার।

নাফিজ নয় যেন রিকশার পাদানিতে ঝুলছে এক টুকরো বাংলাদেশ। ১৭ বছরের নাফিজের বুলেটবিদ্ধ দেহ, রক্ত ঝরে ঝরে নিথর হলেও মাথা থেকে খসে পড়েনি বাংলাদেশের পতাকা।

৪ আগস্ট সকালে বাবার কাছে ৩০ টাকা চেয়েছিলো নাফিজ। বাবা ১০০ টাকা দিতে চাইলেও ৩০ টাকা নিয়েই বাড়ি ছেড়েছিলো। সে টাকা দিয়েই কিনেছিলো পতাকা। এই পতাকা দেখেই মর্গে অসংখ্য মরদেহের ভীড়ে ছেলেকে খুঁজে পেতে দেরি হয়নি বাবার।

গর্ব করে মা বলছিলেন, প্রতিবছর নতুন নতুন পতাকা বানিয়ে বাসার গ্রিলে লটকে দিতো নাফিজ।

নাফিজের মা নাজমা আক্তার বলেন, ‘ও ছোট থেকেই পতাকা খুব ভালোবাসতো। সবসময় স্বপ্ন ছিল দেশ নিয়ে। এ পতাকাগুলো আমি চাইতাম যে আর রাখার দরকার নেই। ও ফেলতে দিত না। কাল দেখি পতাকাগুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা।’

তিনি বলেন, ‘ইদানিং ও বলতো পরিবর্তন যদি না আসে মা, তাহলে আপনার নাফিজ না, কারো বেঁচে থেকে লাভ নেই। পরিবর্তন আনতেই হবে, নাহলে আমরা ঘরের ভেতরে বন্দি।’

বাবা মায়ের যন্ত্রণা, কেন আহত সন্তানকে হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হলো না? যারা ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের কি সন্তান নেই?

নাফিজের বাবা গোলাম রহমান লিটন বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হাসপাতালে নেয়া হলে আমার ছেলে অবশ্যই আল্লাহর রহমতে বেঁচে যেত। কিন্তু ছাত্রলীগ বা পুলিশের বাধার কারণে আমার ছেলেটা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মারা গেল।’

তিনি বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে মেধাবী ছেলেদের যেভাবে মারা হয়েছে সেটা খুবই দুঃখজনক।’

ড্রেনে পড়ে থাকা নাফিজের ক্ষতবিক্ষত দেহ কয়েকজন পুলিশ তুলে দিয়েছিলো এই রিকশায়। মৃত্যু নিশ্চিত না হলে আবারও গুলি চালানোর হুমকিও দিয়েছিলো।

শুরু থেকেই প্রতিটি দিন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো নাফিজ। টিয়ারশেল রাবার বুলেটের আঘাত পেয়েও দমে যায়নি। সবশেষ ৪ আগস্ট মোবাইল মানিব্যাগ সব রেখে ঘর ছেড়েছিলো। যেন শহীদ হবার প্রস্তুতি নিয়েই বেরিয়েছিলো নাফিজ, দাবি তার বড় ভায়ের।

বড় ভাই গোলাম রাসেল বলেন, ‘ওইদিন আসলে আমার ভাই শহীদ হতেই গিয়েছিল। ও ফোন, ওয়ালেট থেকে শুরু করে সব স্মৃতি আমাদের কাছে রেখে গেছে। ও আল্লাহর ডাকে, দেশের ডাকে চলে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘ও সবসময় আম্মুকে বলতো এইযে আবু সাঈদ ভাই, মুগ্ধ ভাই শহীদ হয়েছেন, তারা তো মারা যান নি অমর হয়ে গেছেন।’

নাফিজের মস্তিষ্কে বাংলাদেশ ছাড়া কিছুই ছিলো না। মেধাবীরা দেশ চালাতে না পারলে বদলাবে না বাংলাদেশ, এই ছিলো মাধ্যমিকে জিপিএ পাঁচ পাওয়া নাফিজের চিন্তায়। সেনা অফিসার হয়ে সে দায়িত্ব পালনের স্বপ্নও দেখেছিলো নৌ বাহিনী কলেজের প্রথম বর্ষের নাফিজ।

নাফিজের বাবা বলেন, ‘রিকশায় নাফিজের লাশ তুলে দেয়ার পর চালককেও বকা দেয়া হয়েছে। এরপর তাকে বলা হয়, লাশটা নিয়ে যা, হাসপাতালে যাচ্ছিস কেনো। চালককেও গুলি করে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। তখন এক পুলিশ অফিসার নাকি জিজ্ঞাসা করেছে মরে নাই? মরছে, তাহলে আরো দুইটা গুলি কর।’

বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে নিহত হওয়া নাফিজের বাবার ইচ্ছা, বাংলাদেশ যেন নাফিজের মতো শত শহীদকে ভুলে না যায়। বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের স্বপ্নগুলো যেন পূরণ করে তার উত্তরসূরীরা।