ঢাকা ১২:০২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

যেভাবে রাষ্ট্রতন্ত্র পরিণত হয় স্বৈরতন্ত্রে

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০২:৩৩:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৩৬৮ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

যাদের রক্ত ঘামানো করের টাকায় কেনা হয় পুলিশের বন্দুকের বুলেট, সেই বুলেটই ক্ষতবিক্ষত করেছে কর দেয়া প্রজাতন্ত্রের মালিক নামের ছাত্র জনতাকে। বিগত কয়েক বছরের সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থপাচার, ব্যাংক লুটপাট, নিত্যপণ্যের বাজারে নাভিশ্বাস, সেবা সেন্টারের হয়রানি। সবমিলিয়ে যেনো অনিয়মের এক মহা স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল লাল সবুজের বাংলাদেশ।

বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো জবাবদিহিতা থাকে না, ভোটের জন্য জনগণের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, তখন রাষ্ট্রতন্ত্র পরিণত হয় স্বৈরতন্ত্রে।

বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, যেখানে আপনি দেখবেন ভোটারদের ভূমিকা গৌণ, মুখ্য কোনো ভূমিকা নেই আবার প্রশাসকের ওপর নির্ভর করতে হবে ঠিক ওই জায়গা থেকেই স্বৈরশাসনের উৎপত্তি হয়।’

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, কেমন ছিল বিগত ৩টি সংসদ নির্বাচন। ২০০৮ সালে তত্ত্বাব ধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মাথায় বিচার বিভাগের এক রায়ে তুলে দেয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকেই। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পরের বছর, অর্থাৎ ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন।

সেই কমিশন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের অধীনে যে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশই নেয়নি।

প্রায় ভোটারবিহীন এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দেড় শতাধিক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। ইতিহাসে ওই নির্বাচন এক তরফা নির্বাচন হিসেবে তকমা পেয়েছিল তখন।

কাজী রকিব কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ব্যালট পেপারে সিল মারার সংস্কৃতি শুরু হয়। ওই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচন নিয়েও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল।

নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলি বলেন, ‘১৫৪টি আসনের মানুষ তাদের ভোটাধিকারই প্রয়োগ করতে পারেনি। ভোট দেয়ার সুযোগই তাদের হয়নি। অথচ একটা সংসদ পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছে।’

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক আমলা কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন নির্বাচন কমিশন। বিতর্ক যেনো পিছু ছাড়েনি এই কমিশনেরও। তবে এই কমিশনের ভেতরে থেকে সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের কর্মকাণ্ডে প্রতিবাদে অবস্থানে ছিলেন প্রয়াত সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

বারবার নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সে সময়কার বিতর্কিত সকল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে খতিয়ান রেখে গেছেন তিনি। নানা বিতর্ক ছাপিয়ে নুরুল হুদা কমিশনের গায়ে লাগে রাতের ভোটের কলঙ্কের দাগ। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ‘দিনের ভোট রাতে’ করার অভিযোগ ওঠে ওই কমিশনের বিরুদ্ধে।

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, আমি আগেই বলেছি ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রতীকী অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সারা দুনিয়ায় যারা ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে চায় তারা নির্বাচনকে টুল হিসেবে ব্যবহার করে।’

এরপর শুরু হয় আউয়াল কমিশন যুগ। প্রথমবারের মত আইন করে নিয়োগ দেয়া এই কমিশনকে। যদিও বাছাই করে আওয়ামী লীগের আস্থাভাজনদের দিয়েই কমিশন গঠিত হয়ে বলে অভিযোগ উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে আয়োজন করেছিল আউয়াল কমিশন, ইতিহাসে সেটা ডামি নির্বাচন বলে স্থান পেয়েছে। যদিও সেই নির্বাচনকে ঘিরেও নানা বিতর্কের জন্ম হয়।

স্বাক্ষর ছাড়া ফলাফল শিট তৈরি এবং ভোটের অস্বাভাবিক হার দেখানোর অভিযোগ ওঠে আউয়াল কমিশনের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের দিন সকাল থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে কম ভোটারের উপস্থিতি থাকার পরেও ফলাফলে ৪১ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়ার তথ্য অবাক করেছে সবাইকে।

প্রথম সাত ঘণ্টায় যেখানে ২৭ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানিয়ে শেষ ঘণ্টায় হুট করে আরও ১৪ শতাংশের মতো ভোট বাড়িয়ে হার প্রকাশ করে আউয়াল কমিশন।

তারা বলছেন, সবমিলিয়ে এই ৩টি নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষকে ভোট বিমুখ করে ফেলেছে। বিতর্কিত এসব নির্বাচনের জন্য বিগত ৩টি কমিশনকেই বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলছেন তারা।

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, ‘আগেও এমন নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু পরপর তিনটা নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে।’

জেসমিন টুলি বলেন, ‘তাদের এই দায়িত্বহীনতা দেশকে অনেক খারাপ দিকে নিয়ে গিয়েছে। তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার।’

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নতুন ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে কোনো বিশেষ দলের প্রতি আনুগত্য থাকা ব্যক্তিরা যাতে আর নির্বাচন কমিশনার না হতে পারেন, সে বিষয়েও সজাগ দৃষ্টি রাখার তাগিদ দিয়েছেন নির্বাচন বিশ্লেষক ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।

নিউজটি শেয়ার করুন

যেভাবে রাষ্ট্রতন্ত্র পরিণত হয় স্বৈরতন্ত্রে

আপডেট সময় : ০২:৩৩:০৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪

যাদের রক্ত ঘামানো করের টাকায় কেনা হয় পুলিশের বন্দুকের বুলেট, সেই বুলেটই ক্ষতবিক্ষত করেছে কর দেয়া প্রজাতন্ত্রের মালিক নামের ছাত্র জনতাকে। বিগত কয়েক বছরের সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থপাচার, ব্যাংক লুটপাট, নিত্যপণ্যের বাজারে নাভিশ্বাস, সেবা সেন্টারের হয়রানি। সবমিলিয়ে যেনো অনিয়মের এক মহা স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল লাল সবুজের বাংলাদেশ।

বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো জবাবদিহিতা থাকে না, ভোটের জন্য জনগণের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, তখন রাষ্ট্রতন্ত্র পরিণত হয় স্বৈরতন্ত্রে।

বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, যেখানে আপনি দেখবেন ভোটারদের ভূমিকা গৌণ, মুখ্য কোনো ভূমিকা নেই আবার প্রশাসকের ওপর নির্ভর করতে হবে ঠিক ওই জায়গা থেকেই স্বৈরশাসনের উৎপত্তি হয়।’

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, কেমন ছিল বিগত ৩টি সংসদ নির্বাচন। ২০০৮ সালে তত্ত্বাব ধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মাথায় বিচার বিভাগের এক রায়ে তুলে দেয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকেই। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পরের বছর, অর্থাৎ ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন।

সেই কমিশন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের অধীনে যে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশই নেয়নি।

প্রায় ভোটারবিহীন এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দেড় শতাধিক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। ইতিহাসে ওই নির্বাচন এক তরফা নির্বাচন হিসেবে তকমা পেয়েছিল তখন।

কাজী রকিব কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ব্যালট পেপারে সিল মারার সংস্কৃতি শুরু হয়। ওই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচন নিয়েও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল।

নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলি বলেন, ‘১৫৪টি আসনের মানুষ তাদের ভোটাধিকারই প্রয়োগ করতে পারেনি। ভোট দেয়ার সুযোগই তাদের হয়নি। অথচ একটা সংসদ পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছে।’

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক আমলা কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন নির্বাচন কমিশন। বিতর্ক যেনো পিছু ছাড়েনি এই কমিশনেরও। তবে এই কমিশনের ভেতরে থেকে সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের কর্মকাণ্ডে প্রতিবাদে অবস্থানে ছিলেন প্রয়াত সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

বারবার নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সে সময়কার বিতর্কিত সকল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে খতিয়ান রেখে গেছেন তিনি। নানা বিতর্ক ছাপিয়ে নুরুল হুদা কমিশনের গায়ে লাগে রাতের ভোটের কলঙ্কের দাগ। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ‘দিনের ভোট রাতে’ করার অভিযোগ ওঠে ওই কমিশনের বিরুদ্ধে।

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, আমি আগেই বলেছি ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রতীকী অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সারা দুনিয়ায় যারা ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে চায় তারা নির্বাচনকে টুল হিসেবে ব্যবহার করে।’

এরপর শুরু হয় আউয়াল কমিশন যুগ। প্রথমবারের মত আইন করে নিয়োগ দেয়া এই কমিশনকে। যদিও বাছাই করে আওয়ামী লীগের আস্থাভাজনদের দিয়েই কমিশন গঠিত হয়ে বলে অভিযোগ উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে আয়োজন করেছিল আউয়াল কমিশন, ইতিহাসে সেটা ডামি নির্বাচন বলে স্থান পেয়েছে। যদিও সেই নির্বাচনকে ঘিরেও নানা বিতর্কের জন্ম হয়।

স্বাক্ষর ছাড়া ফলাফল শিট তৈরি এবং ভোটের অস্বাভাবিক হার দেখানোর অভিযোগ ওঠে আউয়াল কমিশনের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের দিন সকাল থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে কম ভোটারের উপস্থিতি থাকার পরেও ফলাফলে ৪১ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়ার তথ্য অবাক করেছে সবাইকে।

প্রথম সাত ঘণ্টায় যেখানে ২৭ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানিয়ে শেষ ঘণ্টায় হুট করে আরও ১৪ শতাংশের মতো ভোট বাড়িয়ে হার প্রকাশ করে আউয়াল কমিশন।

তারা বলছেন, সবমিলিয়ে এই ৩টি নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষকে ভোট বিমুখ করে ফেলেছে। বিতর্কিত এসব নির্বাচনের জন্য বিগত ৩টি কমিশনকেই বিচারের আওতায় আনার দাবি তুলছেন তারা।

নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, ‘আগেও এমন নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু পরপর তিনটা নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে।’

জেসমিন টুলি বলেন, ‘তাদের এই দায়িত্বহীনতা দেশকে অনেক খারাপ দিকে নিয়ে গিয়েছে। তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার।’

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নতুন ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে কোনো বিশেষ দলের প্রতি আনুগত্য থাকা ব্যক্তিরা যাতে আর নির্বাচন কমিশনার না হতে পারেন, সে বিষয়েও সজাগ দৃষ্টি রাখার তাগিদ দিয়েছেন নির্বাচন বিশ্লেষক ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।