অচেনা ঘর। আসবাব, পোশাক, গৃহস্থালি পণ্য, বইপত্র সবই নিয়ে গেছে বানের জল। ভেসে গেছে দোকান পাট, ফসলি জমি, মাছের ঘের, গবাদিপশু। বানভাসি মানুষ ঘরে ফিরে দেখছেন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। উপার্জন বন্ধ হয়ে দিশেহারা কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ছোট দোকানি। গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এমন হাজার হাজার স্বাবলম্বী মানুষকে দ্রুত আয়ের পথে ফিরিয়ে আনাই হবে বন্যা পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ।
কলাগাছের ভেলায় ভাসছে মুরগির ছানা। মাইলের পর মাইল এভাবেই যাত্রা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কোন রকম উপার্জনের একমাত্র সম্বলকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা পিতা-পুত্রের।
মানুষের সাথে গবাদিপশুও পাড়ি দিচ্ছে গলা কিংবা বুক সমান পানি। কোন রকমে বেঁচে থাকার লড়াই সবার। এমন কত শত পশু ভেসে গেছে বানের জলে তার হিসাবও নেই।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে শত শত খামার, গবাদি পশু। সপ্তাহ ধরে নেই খাবার কিংবা পরিচর্যা। শত শত ডিম পড়ে আছে এক একটি খামারে।
প্রায় ৪ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে বিদেশ থেকে ফিরে সমন্বিত খামার করেছিলেন শাহাদাত নামে মীরসরাইয়ের এই উদ্যোক্তা। পানি নামার পর ফিরে দেখেন তার ১৬শ' মুরগি খামার এখন বিরাণভূমি।
ভেসে গেছে পুকুরের মাছও। বন্যায় এ অঞ্চলের এমন হাজারো ছোট উদ্যোক্তা এখন নিঃস্ব। জানান, ক্ষুদ্র ঋণ কিংবা সরকারি সহযোগিতা না পেলে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।
এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘সরকার যদি সহযোগিতা করে তাহলে আমরা নিতে বাধ্য। আমরা যে কিছু করবো সে টাকা নাই। আমি ব্যাংক লোন নেই নি। দীর্ঘ ১১ বছর কুয়েতে ছিলাম। সেখান থেকে যে পুঁজি হয়েছে, তার সঙ্গে স্ত্রীর অলংকার বিক্রি করে বিনিয়োগ করেছি।’
বানের পানি নামায় খুশিতে বাড়ি ফিরছেন অনেকে। কিন্তু বাড়ির অচেনা পরিবেশ দেখে হতবাক বানভাসি মানুষ। বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরে থাকার কোন উপায় নেই। আসবাবাপত্র, গৃহস্থালি পণ্য, বই-খাতা, মূল্যবান সনদ বা দলিল কিছুই অবশিষ্ট নেই।
খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি এ অঞ্চলে এখন প্রয়োজন শত শত ঘরবাড়ি মেরামত, গৃহস্থালি পণ্য ও শিক্ষা উপকরণ সহায়তার।
মীরসরাই ও ফেনীতে মহুর নদীর অববাহিকায় প্রায় ৬ হাজার একরের মুহুরি মাছ চাষ প্রকল্প। দেশে মিঠা পানির বৃহৎ এ প্রকল্পে বছরে উৎপাদন হয় শত কোটি টাকার মাছ। এবারে কন্যায় ভেসে গেছে সব। শুধু এ প্রকল্পেই মৎস্য চাষি আছেন অন্তত ৭ হাজার।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার হিসাবে চট্টগ্রামে এবারের বন্যায় মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ২৯০ কোটি টাকা। কৃষি নির্ভর এ অঞ্চলের মানুষ এখন দিশেহারা। পানিতে তলিয়েছে প্রায় ২ লাখ হেক্টর ফসলি জমি।
আউশের খেত, গ্রীষ্মকালীন সবজি চোখের সামনেই ভেসেছে সব। আবার চাষ শুরু করবেন, সে অর্থও নেই কারো হাতে। এক অধিবাসী জানান, যারা চাষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। চাষীদের প্রতি সরকার যেন দৃষ্টি রাখে সে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।
কৃষক, ক্ষুদ্র খামারি, ব্যবসায়ী বা গ্রামীণ উদ্যোক্তা গ্রামাঞ্চলে অর্থনীতির প্রাণ ধরে রেখেছিলেন যারা, স্বাবলম্বী এসব মানুষ এখন নিঃস্ব, বসে আছেন ঋণের আশায়। আগামীতে তাদের আবারো উৎপাদনের ধারায় দ্রুত ফিরিয়ে আনাই হবে বন্যা পরবর্তী প্রধান চ্যালেঞ্জ।