ভারতের কৌশলে দেশের পোশাক খাত ধ্বংসের মুখে পড়তো!
- আপডেট সময় : ০২:০২:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ৩৬৬ বার পড়া হয়েছে
দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি গেল কয়েক বছর ধরে বাড়িয়েছে দুশ্চিন্তাও। যেখানে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে প্রতিবেশি দেশ ভারত। নিজেদের পোশাক শিল্পকে এগিয়ে নিতে নজর দেয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকে। ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের প্রবেশাধিকার সীমিত করতে নেয়া হয় নানা কৌশল। তবে, সেসব কৌশল বাস্তবায়ন হলে দেশের পোশাক খাত ধ্বংসের মুখে পড়তো বলে দাবি অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টদের।
মাত্র ২৩ লাখ টাকার পোশাকের বাজার এখন প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলার ছুঁয়েছে। আশির দশকে শুরু হওয়া এ শিল্পে যুক্ত হয়েছে শত শত কারখনা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শীর্ষ ১০০ কারখানার মধ্যে ৫০টিই বাংলাদেশে। আর সবুজ কারখানা দুই হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়েছে।
দেশের শীর্ষ এ রপ্তানি খাত যত সমৃদ্ধ হয়েছে, দুশ্চিন্তা যে পিছু ছেড়েছে তা নয়। বড় ধাক্কা আসে ২০১৩ সালে। বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হলেও খাতটির জন্য পরিকল্পিত শিল্পনগরী করতে পারেনি বাংলাদেশ। যদিও এদিক থেকে অনেকটাই এগিয়েছে ভারত। বস্ত্র ও পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে বস্ত্র পল্লী তৈরিসহ গুজরাট, বিহার, তামিল নাডু ও অন্ধ্রপ্রদেশে নানা প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
নিজেদের পোশাক শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ভারতের কু-নজর পড়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতে। যার বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হয় কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের শুরুতেই। ভারতের বাজারে তৈরি পোশাকের প্রবেশাধিকার সংকুচিত করতে নতুন বাজারের তালিকা থেকে ভারতের নাম বাদ দেয়া হয়। তবে, তীব্র সমালোচনার মুখে তা পরিবর্তন করলেও ৩০ জানুয়ারির ওই প্রজ্ঞাপনে প্রণোদনা কমানোর যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা পরবর্তী ছয় মাসে আরও বেড়েছে।
শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাক এর পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তার পরিমাণ চার শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ, ইউরো অঞ্চলে পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ সহায়তা দুই শতাংশ থেকে দশমিক পাঁচ শতাংশ, নতুন বাজারে দুই শতাংশ কমানো হয়েছে। এ ছাড়া বিশেষ নগদ সহায়তা দশমিক তিন শতাংশ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তে মনোবল হারিয়েছেন তৈরি পোশাক উদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে কমেছে রপ্তানিও। এসবের ভূমিকায় সাবেক বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ছিলেন বলে দাবি রপ্তানিকারকদের।
বিজিএমইএ পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ‘এই প্রণোদনাটা কমানো একটা প্রিম্যাচিউর, এর পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে তা আমি ব্যবসায়ী চাইলেই সব বলতে পারবো না। কিন্তু অবশ্যই আমাদের মনে হয়েছে কোনো একটা মহল থেকে গাইডেডলি আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরকে দমিয়ে দেয়ার বা এই সেক্টরে আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তা দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা আমাদের এখানে দেখতে পেয়েছি।’
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এলটিসি গ্রাজুয়েশন তো ২০২৬ সালে, তাহলে ২০২৪ সালে কেন এটাকে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে? এখানে কোনো রহস্য আছে কি না সেটা সরকার খুঁজে বের করবে। গ্রাজুয়েশনের তিন বছর পর্যন্ত আমরা এটা পেতে পারতাম। তাহলে সরকার দেশের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় বা সুযোগটা না নিয়ে কেন এটাকে তড়িঘড়ি করে বন্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারা করলো বা উদ্যোগ নিলো এটাই আমাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।’
দেশিয় কাঁচামাল শিল্প ধ্বংসেও হয়েছে নানা চক্রান্ত। দেশে প্রায় ৫১০টি স্পিনিং মিলের বাৎসরিক সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে প্রায় দেড় কোটি বেল। যা পোশাক শিল্পের প্রায় ৭৫ শতাংশ সুতার চাহিদা পূরণে সক্ষম। তবুও এ খাতের অনেক উদ্যোক্তা সুতা আমদানি করেন। দেশে আমদানিকৃত সুতার প্রায় ৭৫ শতাংশই আসে ভারত থেকে। কিন্তু কেন? মূলত দেশিয় কাঁচামাল কিংবা দেশি সুতা ব্যবহারে উৎপাদিত পোশাক রপ্তানিতে যে পাঁচ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হতো তা কমিয়ে আনা হয়েছে তিন শতাংশের ঘরে। এতে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল আমদানিতে ভারতমুখি হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আর ধ্বংসের মুখে পড়ছে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প।
বিজিএমইএ পরিচালক বলেন, ‘ভারত থেকে শুধু একটা আমদানি পথ দিয়ে দেয়া হয়েছে যে তার থেকে নিয়ে আসলে সুতা ভালো হবে। আমাদের যে একটা অ্যাডভান্টেজ ছিল, আমরা কিন্তু প্রতিযোগিতায় ভারতের চেয়ে অলওয়েজ ভালো করছিলাম। আমাদের রপ্তানি প্রায় ভারতের রপ্তানির চেয়ে চারগুণ বেশি হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশি দেশের বিষয়ে যখনই বিভিন্ন দেশের সাথে আলোচনা করেছি। বিশেষ করে শেষ এক বছর, এই নির্বাচনের পর থেকে আমরা দিতে পেয়েছি।’
বিতর্কিত ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী সরকার ১৫ বছর ধরে ভারতকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা দিয়ে আসছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরাও। জানান, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের পোশাক খাত ধ্বংস হবে, পক্ষান্তরে ভারত এগিয়ে যাবে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে এমন বিষয় ছাড়া ভারতের সাথে অন্য সকল চুক্তি পুনর্বিবেচনার কথা বলছেন তারা অর্থনীতিবিদরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল-আমিন বলেন, ‘এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে, যে পরিমাণ ব্যাকলক ক্রিয়েট করা হয়েছে, তা বিশেষ দেশকে সুবিধা দেয়ার জন্য, বিশেষ কর ভারত। শুধু পোশাক খাত না, ওষুধ খাতসহ আমাদের ইন্টারনাল যে বাই ইস্যুগুলো আছে বাংলাদেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বার্থগুলো দেখা উচিত ছিল। আমাদের শিল্পগুলো যাতে দেশে বসে যায়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ওই খাতে কন্ট্রিবিউশন কম, এটাতে বেড়ে যায় তাহলে এটা হচ্ছে সরকারের পলিসির পার্ট। ভারতীয় পণ্য বন্ধ না হলে আমাদের দেশিয় যে শিল্পগুলো আছে সেগুলো মুখ থুবরে পড়বে।’
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতের অবস্থান শীর্ষ তিনে না থাকায় দেশটির পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থানে আসা খুব একটা সহজ হবে না। তবে, আওয়ামী সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেসব সিদ্ধান্ত হাতে নিয়েছিল তা দেশের শীর্ষ এ রপ্তানি খাতের জন্য যে ইতিবাচক ছিল না তা খোলা চোখেই বোঝা যায়। তবে, তা বাস্তবায়ন হলে পোশাক খাত কোন পথে যেত? সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই নতুন সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তৈরি পোশাক শিল্পকে কতটা প্রাধান্য দিবে সেটিই দেখার অপেক্ষায় রপ্তানিকারকরা।