কর্তৃত্ববাদের শিকল ছিঁড়তে গিয়ে ঘরে ফেরেনি অন্তত ৮৯ জন শিশু ও কিশোর। পরিবারগুলো এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সন্তান হারানোর শোক। যে সন্তান মাতিয়ে রাখতো পরিবারের সবাইকে, সে আজ আর নেই। কখনো ফিরবে না, এ যেন মানতে পারছে না ১ দফা আন্দোলনে শহিদ হওয়া সন্তানের পিতামাতারা। রাষ্ট্রের কাছে কেবল চাওয়া, সুষ্ঠু বিচার।
বাবার কাধে ছেলের লাশ কতটা ভারি? সে জানে কেবল মাহবুবে রহমানের মতন বাবারা। কারণ, বৈষম্যের পারাবাত ভাঙতে গিয়ে আর ঘরে ফেরেনি সৈকত, তার সন্তান, যেমন আর ফেরা হয় নি দেশের অন্তত ৮৯ জন বাবার কলজে চেরা আদরের সন্তান।
সৈকতের বাবা বলেন, ‘ছেলের লাশ বাবার কাঁধে বড় কঠিন জিনিস। আমি চাই না শত্রুর ছেলের লাশও যেন এমন না হয়।’
সৈকত প্রযুক্তিবিদ হবেন। তার মাথাটা অনেক উঁচু হয়ে যাবে। আর ক'টা দিন পরই চোখের সামনে বড় হওয়া ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে যাকে দেখা ছিল বাবা মাহবু্বে রহমানের গোপন শখ, সে ছেলে এখন আর ঘরে নেই। প্রতি সকালে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে যাওয়াটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বপ্নভাঙা, সবহারা এই বাবার।
ঘটনার দিন ১৯ জুলাই, শুক্রবার। দাবি আদায়ের মিছিলে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো সৈকতের বন্ধুরা, কিন্তু তাদের স্তব্ধ করে দিতে রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোকে ব্যবহার করছিলো পতিত হাসিনা সরকার। তার মধ্যে বন্ধু গুলি খেয়েছে শুনে আর বসে থাকতে পারে নি সৈকত। কিন্তু সে যাওয়াই যে তাঁর শেষ যাওয়া, কে জানতো। বলছিলেন, বোন।
সৈকতের বোন বলেন, ‘ও দোকানের সামনে ছিল না। কিন্তু প্রথম একটা গুলি খেয়েই ও মাঠিতে লুটিয়ে পড়ে।’
এমন শুক্রবার আর কখনো আসেনি মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের জীবনে। নূর জাহান রোডের সামনে চলে মুহুর্মুহু গুলি। সেই গুলির মুখে নিস্তেজ হয় সৈকতের দেহ।
বোন আরও বলেন, ‘সবাই পিছে দৌঁড়াচ্ছে কিন্তু ও সামনেই ছিল। ওই সময় পুলিশ বসে গুলি করে। ও পিলারের পিছনে ছিল তারপরেও ওর গুলি লাগে। ’
নুর জাহান রোডের নাম বদলে এলাকা বাসি রাখতে চায় শহীদ সৈকত রোড। টানানো হয়েছে ব্যানার। এতে সৈকতের আত্মত্যাগ মনে রাখতে পারবে এলাকাবাসী।
ফিরোজা বাশার আইডিয়াল স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু সৈকত একজন শহিদ এবং আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের নুরজাহান রোডের প্রথম শহিদ তাই ওর নামেই এ সড়ক হবে।’
বিইউপির শিক্ষার্থী জুবায়ের গিয়েছিল বন্ধুদের সাথে। কিন্তু বন্ধুরা ফিরলেও ফেরেনি জুবায়ের। সব থেকে ছোট ছেলেকে হারিয়ে শোকে যেন পাথর হয়ে গেছেন বাবা।
জুবায়েরের বাবা বলেন, ‘পাঁচ তারিখ আমাকে না বলেই ও আন্দোলনে চলে যায়। যাত্রাবাড়ি যাওয়ার পরে পুলিশ এলোপাথারি গুলি করে সে সময় আমার ছেলের গুলি লাগে।’
বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে হবে বিচারপতি কিন্তু এখন ছেলে হত্যার বিচার পাবে কিনা তা নিয়েই তৈরি হয়েছে সংশয়।
তিনি আরও বলেন, ‘যারা হুকুম দাতা এবং যারা গুলি করেছে তাদের কে তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনা।’
সন্তানের জন্য বাবার আহাজারি প্রকাশ কতটা কঠিন, তা অন্যকেউ বোঝা সম্ভব না। এই পাথর হওয়া বাবাদের রাষ্ট্রের কাছে কেবল একটাই চাওয়া। সন্তানদের যেন দেওয়া হয় শহীদের মর্যাদা আর পান সুষ্ঠ বিচার।