আওয়ামী শাসনামলে যেসব কোম্পানি ও তার মালিক ক্ষমতার দাপটে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, তালিকা করে তাদের সম্পদ ও লেনদেনের তদন্ত করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি নামে-বেনামে যেসব কোম্পানি খোলা হয়েছে, তারও তালিকা করা হচ্ছে। অস্বাভাবিক লেনদেন এবং সেই অর্থের গন্তব্য ধরে কাজ করবে রাজস্ব বোর্ড। জানিয়েছে, সুযোগ থাকলে ফেরত আনা যাবে পাচার করা অর্থও।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে সামনে আসছে নানা খাতের ঢালাওভাবে দুর্নীতির চিত্র। বের হয়ে আসছে সরকারি অনেক কর্মকর্তা থেকে সে সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের অবৈধ সম্পদের পাহাড়। একাধিক গবেষণা বলছে, শেখ হাসিনার শাসন আমলে প্রতিবছর শুধু বিদেশেই পাচার হয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। এবার সে অর্থের পেছনেই এনবিআর।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ৭৩৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়েছে অন্তত ১০টি দেশে। যার মধ্যে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, থাইল্যান্ডে কথিত বাণিজ্যের আড়ালে এসব অর্থ পাঠানো হয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরই, তারই তিন মেয়াদের চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনাও সরে যান পদ থেকে। নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণের পরই নড়েচড়ে বসেছে রাজস্ব বোর্ড।
রাঘব বোয়ালদের ধরতে সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সবধরনের লেনদেনের হিসাব চেয়ে গত কয়েক দিনে ব্যাংকসহ মোট ৯১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছে এনবিআর। এর মধ্যে রয়েছে এস আলম ও তার পরিবার।
তালিকায় আছেন শেখ সেলিম, বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজীজ খান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম।
এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন নিয়ে কাজ করছে এনবিআরের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা সিআইসি। এস আলমসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও এলসি খোলায় সংকুচিত করা হয়েছে। বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ।
এনবিআর বলছে, আয়কর আইন ২০২৩ এর ২০০ ধারা অনুযায়ী খতিয়ে দেখা হচ্ছে সম্পদ। এসব কোম্পানির ব্যাংক হিসাব পাওয়ার পর রিটার্নের সঙ্গে অমিল বা অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর আওয়ামী সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপটে দুর্নীতিবাজরা পার পেলেও এখন সুযোগ রয়েছে এসব অবৈধ অর্থের গন্তব্য খোঁজার।
এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাফী বলেন, ‘টাকাটা মানি লন্ডারিং হয়েছে, কিন্তু প্লেস ট্রেস করা যায়নি। সেক্ষেত্রে এখনকার তার ইন্ডাস্ট্রি বা তার ব্যাংক ব্যালান্স থেকে সংগ্রহ করার আইন আছে। এখন এমন একটা সময়, যে সময়ে রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে কর আদায় ঠেকিয়ে রাখার যে বিষয় বা তথ্য না পাওয়ার কিংবা ভুল তথ্য দেয়ার যে ব্যবস্থা করার জায়গাগুলোতে কিন্তু একটা ভালো সময় এসেছে। বিগত যে সময়ে রাজস্বের ক্ষতি হয়েছে, সেই বিষয়টা কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে পুষিয়ে নিতে পারে।’
অবৈধ আয় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে এনবিআরের অভ্যন্তরেও। একইসঙ্গে রাজস্ব কার্যক্রম পূর্ণ অনলাইনকরণের মাধ্যমে আধুনিক না করলে সফলতা আসবে না বলে মত বিশ্লেষকদের।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতির যে জায়গাগুলো আছে, সেগুলোতে হাত দিতে হবে। সেখানে আইনকানুনেরও কিছু কিছু সংস্কার করতে হবে। আর আমরা প্রযুক্তিকে যত বেশি ব্যবহার করতে পারবো, আমাদের বিভিন্ন জায়গার লিকেজগুলি তত বেশি ধরতে পারবো। আবার অন্যদিক থেকে রাজস্ব আদায়ও আমরা বেশি করতে পারবো।’
বড় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি নামে বেনামে যেসব যেসব প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক লেনদেন করেছে সেসব কোম্পানি ও ব্যক্তির তালিকা করছে এনবিআর। শিগগিরই তাদেরকে তদন্তের আওতায় আনতে কাজ করছে সিআইসি ও কর অঞ্চলগুলো।