গেলো ১৪ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণ গেছে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশির। এমন বিচার বহির্ভূত হত্যার কোনো বিচার হয়নি। উল্টো নির্দোষ প্রমাণ হয়েছেন অনেকেই। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই সীমান্ত হত্যা ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুয়াশা ঢাকা ভোরে বাবার সঙ্গে দেশে ফিরছিল ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানী। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া মই বেয়ে পার হওয়ার সময় জড়িয়ে যায় পোশাক। ভয়ে চিৎকার দেয় ফেলানী। ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী সেই চিৎকারের জবাব দেয় গুলি চালিয়ে। মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ফেলানী। নয়াদিল্লীতে গৃহকর্মীর কাজ করা ফেলানীর দেশে ফিরে বসার কথা ছিল বিয়ের পিঁড়িতে। অথচ তার প্রাণহীন দেহটি পাঁচ ঘণ্টা ধরে উল্টোভাবে ঝুলে থাকে কাঁটাতারে।
এই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ও ন্যায়বিচারের দাবি থাকলেও প্রধান আসামি বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ ও তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিএসএফের নিজস্ব আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। বকেয়াই রয়ে যায় ফেলানীর রক্তের ঋণ।
পরিসংখ্যান বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে বিএসএফের গুলিতে মারা গেছেন ৫৭৯ জন বাংলাদেশি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরেই সীমান্তে সর্বোচ্চ ৯৮ জন বাংলাদেশি নিহত হন। এরপর ধারাবাহিকভাবেই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারাতে থাকেন বাংলাদেশিরা। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রথম পাঁচ বছরে ২৭০, মধ্যবর্তী পাঁচ বছরে ১৪৬ ও শেষ পাঁচ বছরে ১৬২ জন ধরাশায়ী হন বিএসএফের গুলিতে।
এতো মৃত্যুর পরও বিএসএফের কোনো সদস্যের বিচারের তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ এই সময়ে সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায়নি শেখ হাসিনা সরকারকে। জানানো হয়নি কোনো প্রতিবাদও। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের ভারতের সাথে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই সীমান্ত হত্যা ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, 'এটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারা হয়তো প্রতিবাদ করেননি, কারণ তাদের মনে হয়েছে এই প্রতিবাদ করে অন্য পক্ষের মন খারাপ তারা হয়তো করতে চায়নি। স্পষ্টভাবে আমরা সেভাবে কথা বলিওনি। তারা হয়তো মনে করেছে যে এটা করলে সামাল দেয়া যায়, তখন তারা এটা করেই গেছে। কিন্তু এটা অনভিপ্রেত।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক বলেন, 'মানুষ কেন্দ্রিক যে বাস্তবতা, এটা আসলে আর্টিফিসিয়াল বর্ডার যখন আঁকা হয়েছে, তারপর যে নীতি করা হয়েছে সেটা রিফ্লেক্টেড হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এখানে সদিচ্ছার অভাব ছিল নিঃসন্দেহে। ভারতের দিক থেকে সদিচ্ছার অভাব ছিল, বাংলাদেশের দিক থেকে কোনো অবস্থান নেয়া হয়নি। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি যদি বেশি রাজনৈতিক শোনায় তাহলে হয়তো বলা যাবে যে আমাদের দিক থেকে তুষ্ট করার একটা প্রবণতা ছিল।'
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যার সমাধানে ১৯৭৫ সালে তৈরি করা হয়েছিল বর্ডার গাইড লাইন। দু'দেশের মধ্যে সম্পাদিত এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিলে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, বেআইনিভাবে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করলে সীমান্তরক্ষীরা গ্রেফতার করে তাদের দেশের পুলিশের কাছে সোপর্দ করবে। সাবেক রাষ্ট্রদূত বলছেন, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলি করে মানুষ হত্যা বর্ডার গাইডলাইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কোনোভাবেই এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নীরব থাকার সুযোগ নেই।
এম হুমায়ূন কবির বলেন, 'এটা আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। যে যুক্তিতেই এটা ব্যাখ্যা করেন এটা আইন বহির্ভূত। কারণ যে লোকটাকে হত্যা করা হয়, ধরেই নিলাম সে অপরাধী, কিন্তু তাকে তো তার বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দিতে হবে। সুযোগ না দিয়ে যখন এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে নিয়োজিত হয় তারা নিশ্চিতভাবেই এটা একটা আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।'
তবে সম্প্রতি মৌলভীবাজারের স্বর্ণা দাস আর ঠাকুরগাঁওয়ের জয়ন্ত কুমার হত্যার কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে দিল্লীকে চিঠি দিয়েছে ঢাকা। দু'দেশের সীমান্তে বিএসএফের নিয়মিত এমন গুলির ঘটনাকে ভারত বাংলাদেশের সুসম্পর্কের পথে বড় বাধা বলছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, 'যেখানেই আমাদের সুযোগ হবে, সেখানেই আমরা বলবো, এটা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তু'দেশের স্বার্থেই উচিত এটা থেকে বেরিয়ে আসা। এটা ভারতের কোনো উপকার করছে এরকম কাউকে আমি বলতে শুনিনি।'
যদিও ঢাকার প্রতিবাদে এখনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি দিল্লী। ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও তিনি এড়িয়ে যান।
তবে সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শক্ত অবস্থানকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।
অধ্যাপক ওবায়দুল হক বলেন, 'এটা ভালো যে, আমরা দেখেছি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা খুব শক্তপোক্তভাবেই একটা অবস্থান নিয়েছেন এবং বলছেন যে আমাদের অবস্থান কী। এবং আমরা ভালো শক্ত প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছি। আমার মনে হয়, এটা খুব ভালো শুরু। আমরা হয়তো এটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমাদের জন্য বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসলে সুসম্পর্কের জন্য এটা হবে না এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতি আরও আগে নিতে পারলে ভালো হতো।'
যদিও একাধিকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাস দিলেও সে বিষয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ভারত।