জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের প্রায় ৫৯ শতাংশই অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার হয়েছে। যথাযথ নজরদারি অভাব আর অগণতান্ত্রিক উপায়ে তৈরি বিদেশি ঋণনির্ভর পরিকল্পনা বাতিলের দাবি জানান জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে, জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কঠোর হওয়ার প্রতিশ্রুতি অন্তর্বর্তী সরকারের।
প্রান্তরজুড়ে সবুজের বিস্তৃতি, নদীময় বদ্বীপ। দু'চোখে প্রশান্তি এনে দেয়া সৌন্দর্যের আঁধার বাংলাদেশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমাত্রিক সংকটে প্রকৃতি-পরিবেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ। ভৌগলিক কারণেই এর অভিঘাতে ক্ষতির মুখে পড়ছে বাংলাদেশ।
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সর তথ্য বলছে, বৈশ্বিক জলবায়ুঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রতিনিয়ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, আকস্মিক বন্যাসহ নানা দুর্যোগে বিপর্যস্ত জনজীবন। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এসব দুর্যোগের তীব্রতা ও ক্ষতি মোকাবিলায় তৈরি হয়নি প্রায়োগিক সক্ষমতা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় ২০০৯ সালে নিজস্ব অর্থে জলবায়ু তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ সরকার। পরে তহবিল পরিচালনায় একটি আইনও করা হয়। তবে বিগত সরকারের সময়ে নেয়া মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন নীতি সুনির্দিষ্ট কোন কাজে আসেনি। বরং বাস্তবায়ন অযোগ্য, জনবিচ্ছিন্ন জলবায়ু নীতির মাধ্যমে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৮৫১টি প্রকল্পে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে এর সিংহভাগই জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কর্মকান্ডে ব্যবহার হয়নি। বরং ব্যয় হয়েছে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে।
প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৫৯ শতাংশই অবকাঠোমো উন্নয়নে ব্যবহার হয়েছে। করা হয়নি যথাযথ নজরদারি। ফলে জলবায়ু ঝুঁকি হ্রাসের পরিবর্তে তৈরি হয়েছে নতুন ঝুঁকি। শুধু তাই নয়, তহবিলের টাকায় সড়কবাতি বসানো, নর্দমা নির্মাণের মতো কাজও হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড পরিচালনা বোর্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অভাব রয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমানোসহ জলবায়ু প্রশমন ও অভিযোজন কার্যক্রমে দেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় গুরুত্ব। তাই অগণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে করা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা বাতিলের পাশাপাশি আইনি সংস্কারের দাবি তাদের।
বাংলাদেশ জলবায়ু ন্যায্যতা জোটের সমন্বয়কারী মো. শামছুদ্দোহা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের কল্যাণে ব্যয় না করে যেখানে খুব দ্রুত টাকা ব্যয় করা যাবে সেখানে টাকা দেয়া হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে যে ফান্ড দেয়া হচ্ছে তা ডিরেক্ট জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে লিংক থাকতে হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনেই ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। তবে যেসব প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা উঠেছে তা বিবেচনা করেই বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি তাদের।
জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, ‘বির্তকের উদ্ধে রেখে ঢালাওভাবে স্ট্রিট লাইট বা সোলার প্যানেল লাইন স্থাপনের প্রকল্প দিবো না।’
বন-পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জানান, চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নে জলবায়ু ফান্ডের অর্থ কেউ যাতে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে তার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের গঠন প্রক্রিয়া বদলে ফেলারও পরিকল্পনা আছে।
বন-পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘অনেক অভিযোগ আছে যে কখনো পরিবেশ নিয়ে কাজ করেনি কিন্তু নীতি নির্ধারকের ঘনিষ্ট হওয়ায় অনেক টাকা পেয়ে গিয়েছে।’
শূন্য কার্বন অর্থনীতিতে পৌঁছানোর সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরির পাশাপাশি নতুন করে জলবায়ু নীতি-পরিকল্পনায় প্রয়োজনমাফিক সংস্কার আনার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।