লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ নিশ্চিত করেছে তাদের প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করে তারা।
গতকাল বিকেলে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। ওই হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয় হিজবুল্লাহর সদর দপ্তরকে। হামলার সময় সেখানে ছিলেন হাসান নাসরুল্লাহ।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগারি জানান, বিমানবাহিনী হিজবুল্লাহর প্রধান সদর দপ্তর লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। হামলায় ২ হাজার কেজির বাঙ্কার বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া হয় অত্যাধুনিক এফ-৩৫ বিমান থেকে।
নাসরুল্লাহর মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে দেওয়া বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ বলেছে, “প্রতিরোধের মাস্টার, ধর্মনিষ্ঠ বান্দা তার সৃষ্টিকর্তার কাছে যেতে একজন শহীদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন।”
“সৈয়দ হাসান নাসরুল্লাহ, হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল, যোগ দিয়েছেন তার সেরা, অমর সহযোগীদের সঙ্গে। যাদের তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর একের পর এক জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “আমরা আমাদের সহমর্মিতা এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি তার সাথের শহীদদের, যারা তার সঙ্গে এই পবিত্র পথে যাত্রা করেছে বৈরুতে বিশ্বাসঘাতক ইহুদিবাদীদের হামলায়।”
হিজবুল্লাহ আরও জানিয়েছে, যদিও তাদের প্রধান নেতা নিহত হয়েছেন তা সত্ত্বেও গাজা ও ফিলিস্তিনিদের সহযোগিতায় লেবাননের প্রতিরক্ষায় শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের জিহাদ অব্যাহত থাকবে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, নাসরুল্লাহর মৃত্যু হিজবুল্লাহর জন্য একটি বড় ক্ষতি। কারণ তিনি ছিলেন এক ‘ক্যারিশমাটিক’ নেতা। যার এক কথায় রাস্তায় নেমে আসতেন হাজার হাজার মানুষ। এখন হিজবুল্লাহর দায়িত্ব কার হাতে আসবে সেটি নিশ্চিত নয়। তবে নতুন নেতৃত্বের সবকিছু গুছিয়ে নিতে সময় লাগবে।
হাসান নাসরুল্লাহ কে ছিলেন?
নাসরুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম পরিচিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তবে মৃত্যুর আগে নাসরুল্লাহকে গত এক বছরে একবারও প্রকাশ্যে বের হতে দেখা যায়নি। কারণ তিনি সব সময় ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার শঙ্কায় ছিলেন। হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৬০ সালে বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন সবজিবিক্রেতা। তিনি তার ৯ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন।
নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত জীবন ছিল ছায়াবৃত। তার সঙ্গে ইরানের ছিল খুবই গভীর সম্পর্ক। এই ইরানের সহায়তা নিয়েই হিজবুল্লাহকে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছিলেন তিনি। হিজবুল্লাহর সব সদস্য নাসরুল্লাহকে সম্মান করতেন।
নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসসহ ইরাক ও ইয়েমেনের যোদ্ধাদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছে হিজবুল্লাহ। এছাড়া ইরানের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে অত্যাধুনিক রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র। যেগুলো দিয়ে ইসরায়েলে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের।
নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহকে একটি সাধারণ সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে লেবাননের সেনাবাহিনীর চেয়ে হিজবুল্লাহর শক্তি-সামর্থ বেশি হয়ে যায়। তাদের লক্ষ্যই ছিল দখলদার ইসরায়েলকে লেবানন থেকে তাড়ানো।
১৯৮৫ সালে হিজবুল্লাহ আত্মপ্রকাশ করে। ওই সময় একটি খোলা চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইসলামের শত্রু হিসেবে অভিহিত করে দলটি। এছাড়া ইসরায়েলের বিলুপ্তিরও দাবি জানায় তারা।
হিজবুল্লাহর উত্থানের সময় নাসরুল্লাহ নেতৃত্বে আসেন। তিনি জানিয়েছিলেন, একজন সাধারণ যোদ্ধা হিসেবে লড়াই করার পর তিনি প্রথমে লেবাননের বালবেকের পরিচালকের দায়িত্ব পান। এরপর পান পুরো বেকা অঞ্চলের। সবশেষে বৈরুতের দায়িত্ব আসে তার কাঁধে।
১৯৯২ সালে হিজবুল্লাহর তৎকালীন প্রধান নেতা আব্বাস-আল-মুসাওই ইসরায়েলি হেলিকপ্টার হামলায় প্রাণ হারান। এরপর মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধানের দায়িত্ব পান হাসান নাসরুল্লাহ।
নাসরুল্লাহ দায়িত্ব নিয়েই সবার প্রথমে আব্বাস-আল-মুসাওইর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্যোগ নেন। তিনি দখলদার ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট ছোড়ার নির্দেশ দেন।
এছাড়া ইসরায়েলি সেনাদের লেবানন থেকে হটাতেও কাজ করতে থাকেন তিনি। যার প্রেক্ষিতে ২০০০ সালে ইসরায়েলি বাহিনী দখলকৃত লেবাননের অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে ওই সময় ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে তার ছেলে প্রাণ হারায়। ইসরায়েলি সেনাদের লেবানন থেকে পালানোর বিষয়টি আরব বিশ্বের প্রথম জয় হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন নাসরুল্লাহ। এছাড়া তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা লেবাননের সব ভূখণ্ড উদ্ধার না করবেন ততক্ষণ হিজবুল্লাহ অস্ত্র ফেলে দেবে না।
এরপর থেকে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার তীব্রতা অনেকটাই কমে আসে। তবে ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরায়েলে আকস্মিক অভিযান চালায়। ওই সময় তাদের হামলায় ৮ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়। এরপর ইসরায়েল লেবাননে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। যা পরবর্তীতে একটি যুদ্ধে রূপ নেয়। এই যুদ্ধ দীর্ঘ ৩৪ দিন চলার পর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বন্ধ হয়।
২০০৬ সালের এই যুদ্ধের সময় নাসরুল্লাহর বাড়ি এবং অফিস লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। কিন্তু তিনি অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান।
এই যুদ্ধের পর হামাস-ইসরায়েলের মধ্যে আর কোনো সংঘাত হয়নি। তবে গত বছর হামাস যখন ইসরায়েলের অবৈধ বসতি লক্ষ্য করে হামলা চালায় তখন তাদের সহযোগিতায় হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট হামলা চালানো শুরু করে।