গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হামাসকে সমর্থন দিয়ে ইসরাইল সীমান্তে কয়েক দফায় রকেট হামলা চালায় ইরান সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। বৈরুতকে কয়েক দফায় সতর্ক করলেও লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে ইসরাইলি সেনা ও হিজবুল্লাহর মধ্যে চলতে থাকতে হামলা-পাল্টা হামলা। শেষ পর্যন্ত হিজবুল্লাহ প্রধানকে হত্যার পর আবারও আলোচনায় হিজবুল্লাহ-ইসরাইল সম্পর্ক।
ইরানের রাজধানী তেহেরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার দুই মাস যেতে না যেতেই হিজবুল্লাহ’র প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী। যেকোনও সময় লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করতে পারে তেলআবিব- এমন শঙ্কায় দেশ ছাড়ছেন হাজার হাজার বাসিন্দা। আর, প্রতিশোধের আগুনে পুড়তে থাকা ইরান ও হিজবুল্লাহ- ইসরাইলকে ছেড়ে কথা বলবে না- এমন আভাসও দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
গেল বছরের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি হয়- যদিও দু’পক্ষের মধ্য শত্রুতার শুরু আরও ৫০ বছর আগে।
১৯৮২ সালে প্রথম লেবানন আক্রমণ করে ইসরাইল। লেবাননে সাত বছর ধরে চলমান গৃহযুদ্ধের মধ্যেই চলে এ অভিযান। বিশেষ করে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের হামলার প্রতিশোধ নিতেই এই হামলার দাবি করে তারা। এসময়, ইসরাইলকে পাল্টা জবাব দিতে ছোট ছোট সংগঠনের জন্ম হয় লেবাননে। এরমধ্যে শিয়া মুসলিম কমিউনিটি অন্যতম। ইসরাইলকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প নিয়ে গঠিত হয় ইরান সমর্থিত মুসলিম নেতাদের ‘ব্রেইনচাইল্ড’ হিসেবে খ্যাত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ।
১৯৮২ থেকে ৮৬ সাল পর্যন্ত বৈরুতে অবস্থিত পশ্চিমা দূতাবাস ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা করে একাধিক সশস্ত্র সংগঠন। ১৯৮৩ সালের অক্টোবরে এমন একটি হামলায় ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের ৩ শতাধিক মধ্যস্থতাকারী নিহত হয়। শুরুতে ইসলামিক জিহাদি সংগঠনের নাম সামনে আসলেও পরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দাবি করে এতে হিজবুল্লাহ সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল।
১৯৫৮ সালকে হিজবুল্লাহ’র উত্থানের বছর হিসেবে উল্লেখ করেন ইতিহাসবিদরা। দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরাইলি সেনাদের তাড়িয়ে দিতে সফল হয় সংগঠনটি। ১৯৯২ সালে গৃহযুদ্ধের অবসানের পর দেশটির সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় হিজবুল্লাহ। সে বছর ১২৮টি আসনের ৮টি জয়লাভ করে ক্ষমতার কাছাকাছি চলে আসে তারা। জনপ্রিয়তা বেড়ে বর্তমানে লেবাননের সংসদে ৬২টি আসন হিজবুল্লাহ’র।
২০০৬ সালে জুলাইয়ে ইসরাইলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ৩ সেনা সদস্যকে হত্যার পর তাদের মরদেহ গুম করে বন্দিবিনিময়ের শর্ত দেয় হিজবুল্লাহ। এর দু’বছর পর ৫ বন্দিকে লেবাননে ফেরানোর শর্তে নিহত সেনাদের লাশ পাঠানো হয় তেল আবিবে।
২০০৯ সালে সংগঠনের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের মধ্যদিয়ে লেবাননের শত্রুদের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত জানায় হিজবুল্লাহ। ২০১২ সালে গৃহযুদ্ধের সময় দামাস্কাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে সিরিয়ায় সদস্য মোতায়েনের ঘোষণা দিলে আরব নেতাদের তীব্র সমালোচনার স্বীকার হয় সংগঠনটি। এতে আইসিসের আগ্রাসন প্রতিহত করার পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যাপক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সক্ষম হয় হিজবুল্লাহ।
২০২৩ সালে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ইসরাইল সীমান্তে রকেট হামলা চালিয়ে হামাসকে পূর্ণ সমর্থন দিতে শুরু করে সংগঠনটি। এতে ৬০ হাজারেরও বেশি সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় তেল আবিব। আর বাস্তুচ্যুত হন লেবাননের প্রায় ১ লাখ বাসিন্দা। তবে মূল সংঘাতের সূত্রপাত ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে সিরিজ পেজার বিস্ফোরণের পর। যার চূড়ান্ত পরিণতি ইসরাইলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যু।
৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান এই বৈরিতা এখন কোন দিকে মোড় নেবে সেটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ইরান ও হিজবুল্লাহ’র প্রতিশোধ নাকি নেতানিয়াহুর ধুরন্ধর যুদ্ধনীতি- কী অপেক্ষা করছে মধ্যপ্রাচ্যের সামনে- এখন সেদিকেই তাকিয়ে বিশ্ব।